অর্থকাগজ প্রতিবেদন
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে। বিশেষ করে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সবজির দাম কমে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত জুন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৪৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ৭.৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির এই নিম্নগতি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের দৈনন্দিন আয়ের একটি বড় অংশ খাদ্য কেনায় ব্যয় হয়। তবে, সংকটের বিষয় হলো, মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের মজুরি বাড়েনি, যা ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছে। মূল্যস্ফীতির হার কমে আসায় মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির ব্যবধান কমে এসেছে, যা মানুষের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের 'ইনফ্লেশন ডায়নামিকস ইন বাংলাদেশ: এপ্রিল-জুন ২০২৫' শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যপণ্যের গড় অবদান কিছুটা কমেছে। খাদ্য ও জ্বালানিবহির্ভূত পণ্যের অবদান বেড়েছে। এই প্রান্তিকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্য ও জ্বালানিবহির্ভূত পণ্যের গড় ভূমিকা ছিল ৪৯.৭ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪৫.৭ শতাংশ। একই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির গড় ভূমিকা কমে ৪৩.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা এর আগের প্রান্তিকে ছিল ৪৫.৩ শতাংশ। অন্যদিকে, তৃতীয় ও চতুর্থ উভয় প্রান্তিকে সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে জ্বালানি পণ্যের গড় ভূমিকা ছিল ৯ শতাংশ।

এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সবজির দাম কমা খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এই প্রান্তিকে সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সবজির ভূমিকা ছিল মাত্র ৪.১ শতাংশ, যা আগের (তৃতীয়) প্রান্তিকে ছিল ১৪.১ শতাংশ। তবে, খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে শস্যজাতীয় খাদ্য। চতুর্থ প্রান্তিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে শস্যজাতীয় খাদ্যের ভূমিকা ছিল ৪৩.৭ শতাংশ, যা গত কয়েক প্রান্তিকের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমিষজাতীয় খাদ্যের ভূমিকা ছিল ৩৩.৯ শতাংশ। যদিও আমিষের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য, তবে চতুর্থ প্রান্তিকে আমিষের দাম কমে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে আমিষের ভূমিকা কমেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। খাদ্যপণ্যের মধ্যে সোনালি মুরগি, মাঝারি মানের চাল, সয়াবিন তেল ও মসুর ডালের দাম চতুর্থ প্রান্তিকের মাঝামাঝি সময়ে কমলেও শেষ দিকে আবার বেড়ে যায়। বিশেষ করে জুন মাসে সোনালি মুরগির দাম অনেকটা বেড়ে যায়, যদিও এপ্রিল ও মে মাসে সোনালি মুরগির দাম রেকর্ড পরিমাণে কমেছিল। এছাড়া, আলু, কাঁচামরিচ ও পেঁয়াজের দাম এই প্রান্তিকে অনেকটা স্থিতিশীল ছিল।

খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে কাপড় ও জুতার দাম। এই সময় এই দুটি পণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, যা খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে ১৭.৮ শতাংশ ভূমিকা রেখেছে। জ্বালানির ভূমিকা ছিল ১৪.৬ শতাংশ। এছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও অন্যান্য পণ্যের ভূমিকা ছিল স্থিতিশীল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, "মৌসুমি কারণ ও সরবরাহ ঠিক থাকার কারণে বাজারে সবজির দাম কমেছে। আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, সরবরাহ ঠিক থাকলে বাজারে কারসাজির সুযোগ কম থাকে। সেটা হয়তো কিছুটা হয়েছে। তবে বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। বন্যার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ফলে এসব খেয়াল রেখে এবং কবে কখন কী সংকট হতে পারে, তা নিরূপণ করে নীতি নির্ধারণ করতে হবে।" সামগ্রিকভাবে সেলিম রায়হান মনে করেন, কিছুটা স্বস্তি হয়তো এসেছে; কিন্তু এখনো সন্তুষ্ট হওয়ার অবকাশ নেই। এই ধারা টেকসই করতে নীতিগত সমন্বয় থাকতে হবে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, তিন বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এই সময়ে ধারাবাহিকভাবে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম ছিল। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে, যার ফলে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং প্রকৃত আয় কমেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যখন মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করে, তখন থেকে এই ব্যবধান কমতে থাকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিক এপ্রিল-জুনে মজুরি ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, বিশেষ করে জুন মাসে। এই ঘাটতি কমে আসার পেছনে মূল কারণ ছিল বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার কমে আসা। চতুর্থ প্রান্তিকে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৯ শতাংশ। একই সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল তুলনামূলক স্থিতিশীল—গড়ে ৮.২ শতাংশ। ফলে পারিবারিক ক্রয়ক্ষমতা এখন কিছুটা বাড়ছে। 'মোমেন্টাম ইফেক্ট' বা গতিপ্রবাহের প্রভাবের কারণে মাঝেমধ্যে ওঠানামা দেখা গেলেও মজুরি বৃদ্ধির গতি পুরো প্রান্তিকজুড়েই তুলনামূলকভাবে মন্থর ছিল। এর অন্যতম কারণ হলো এত দিন মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে উচ্চ ব্যবধান ছিল। অর্থাৎ আগে এই ব্যবধান বেশি থাকায় পরবর্তীকালে কমলেও তার প্রভাব তেমন একটা দেখা যায় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে মজুরি বৃদ্ধিতে সামগ্রিকভাবে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা গেছে, যদিও প্রান্তিকের শেষ দিকে এসে তা সামান্য কমেছে। দেশের সব বিভাগেই আগের প্রান্তিকের তুলনায় সামান্য হারে মজুরি বেড়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে মজুরি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মজুরি বৃদ্ধির গতি এখনো কম এবং তার ইতিবাচক প্রভাব তুলনামূলকভাবে সীমিত। এই প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে ধারাবাহিক নীতিগত তৎপরতা অপরিহার্য।
অকা/প্র/ই/সকাল/৩১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে

Leave A Reply

Exit mobile version