অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সাম্প্রতিক সময়ের স্থিতিশীলতা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও বাজারে চাহিদা–সরবরাহের পরিবর্তিত বাস্তবতার সম্মিলিত ফল। নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান নীতি-উপকরণ, যার মাধ্যমে তারা বিনিময় হারকে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিসরে রাখতে চায়। গত মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) ১৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রতি ডলার ১২২ টাকা ২৯ পয়সা দরে মোট ২০২ মিলিয়ন ডলার কেনার মাধ্যমে চলতি অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৫১ বিলিয়ন ডলার। এই নীতি জুলাই থেকে চালু, এবং এর লক্ষ্য বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ থাকলে তা শোষণ করে দরপতন ঠেকানো এবং রিজার্ভকে ধীরে ধীরে পুনর্গঠন করা।

ডলারের দাম কমার পেছনে দৃশ্যমান কারণের বাইরে আরও গভীর অর্থনৈতিক সংকেত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বড় ধরনের বৈদেশিক পেমেন্টের চাপ কমে যাওয়ায় বাজারে তাৎক্ষণিক ডলার চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে চলমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগকারীদের সতর্ক অবস্থান, রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার কারণে দেশে নতুন ব্যবসা, শিল্প সম্প্রসারণ বা মূলধনী প্রকল্পে গতি নেই। এর প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিতে—সেপ্টেম্বর শেষে তা নেমে এসেছে ৬.২৯ শতাংশে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। ঋণ না বাড়া মানে নতুন উৎপাদন, আমদানি বা যন্ত্রপাতি ক্রয় কমে যাওয়া—ফলে ডলার চাহিদাও স্বাভাবিকভাবেই নিচে নেমেছে।

এই প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স প্রবাহ একটি ভারসাম্য সৃষ্টিকারী ভূমিকা পালন করছে। নভেম্বর শেষে প্রবাসীরা ২.৮৯ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে বাজারকে আরও স্থিতিশীল করেছে। সরবরাহ বাড়লেও প্রকৃত আমদানি চাহিদা বাড়ছে না—এটি বাজারের স্থিতিশীলতার আড়ালে থাকা অর্থনৈতিক মন্থরতার স্পষ্ট সূচক। অর্থাৎ ডলার-দরের স্থিতিশীলতা শক্তিশালী অর্থনীতির কারণে নয়; বরং দুর্বল চাহিদার প্রতিফলন।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনার সিদ্ধান্ত কৌশলগত। প্রথমত, গত দুই বছরের সংকটে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এখন বাজারে চাপ কম থাকা অবস্থায় তারা সুযোগ নিচ্ছে রিজার্ভ পুনর্গঠনের। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে ডলারের দর অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে রপ্তানি প্রতিযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে—এ ঝুঁকি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে কিছুটা ডলার তুলে নিচ্ছে। তৃতীয়ত, নিলাম পদ্ধতি বাজারকে বার্তা দিচ্ছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সক্রিয়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনমতো হস্তক্ষেপ করবে—যা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করে।

সার্বিক চিত্রটি তাই দ্বিমুখী: একদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ, ব্যাংকগুলোর উচ্চ ডলার সরবরাহ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজার ব্যবস্থাপনা বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখছে; অন্যদিকে বিনিয়োগ, আমদানি ও ঋণ প্রবৃদ্ধির পতন দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মন্থরতা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। এই স্থিতিশীলতা তাই আংশিক সফলতা, আংশিক সতর্কতার ইঙ্গিত—যা ভবিষ্যৎ নীতি-পরিকল্পনায় আরও গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
অকা/প্র/ই/সকাল/১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 9 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version