অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

দেশের শেয়ার বাজারে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারে টানা দরপতনের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে বাজার মূলধনের চিত্রে। চলতি বছরজুড়ে বাজারের ওঠানামায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলা শীর্ষ ১০ কোম্পানির সম্মিলিত বাজার মূলধন কমেছে ২১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এতে সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা গভীর হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির মোট বাজার মূলধন যেখানে বেড়েছে ৫ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা, সেখানে শীর্ষ ১০ কোম্পানির বাজার মূলধন একই সময়ে কমেছে ২১ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। এই বৈপরীত্যই স্পষ্ট করে দিচ্ছে, বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর দরপতন পুরো বাজারকে নিচের দিকে টেনে ধরেছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যাওয়ার কারণেই সারা বছর সূচক ও লেনদেন দুটিই নিম্নমুখী প্রবণতায় ছিল।

আর মাত্র কয়েক দিন পর শেষ হতে যাওয়া বছরে বাজার মূলধনের ভিত্তিতে শীর্ষে থাকা ১০ কোম্পানির মধ্যে ৭টির মূলধন কমেছে, বেড়েছে মাত্র ৩টির। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতের গ্রামীণফোন লিমিটেড। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৪৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের ২৮ ডিসেম্বর নেমে এসেছে ৩৫ হাজার ১৪৮ কোটি টাকায়। এক বছরে গ্রামীণফোনের বাজার মূলধন কমেছে ৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা, যা শীর্ষ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশও বড় অঙ্কের বাজার মূলধন হারিয়েছে। গত বছরের শেষে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ১৯ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৩১১ কোটি টাকায়। ফলে এক বছরে কমেছে ৬ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। একই সময়ে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের বাজার মূলধন ২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা কমে ১৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা থেকে নেমে এসেছে ১২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকায়।

ওষুধ খাতের শীর্ষ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের বাজার মূলধনও বছরজুড়ে চাপের মুখে ছিল। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর যেখানে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ১৯ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা, সেখানে চলতি বছরের ২৮ ডিসেম্বর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকায়। এতে এক বছরে কমেছে ১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এছাড়া রং ও নির্মাণসামগ্রী খাতের বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের বাজার মূলধন কমেছে ১ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, যা ৮ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকায়।

বিদ্যুৎ খাতের ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বাজার মূলধন এ বছর কমেছে ৪৮১ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৭ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায়। একই সময়ে টেলিযোগাযোগ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান রবি আজিয়াটার বাজার মূলধন কমেছে ১৫৭ কোটি টাকা, যা ১৪ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা থেকে নেমে এসেছে ১৪ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকায়।

তবে সব শীর্ষ কোম্পানির ক্ষেত্রে দরপতনের চিত্র নয়। ব্যাংক খাতে ব্র্যাক ব্যাংক এ বছর উল্লেখযোগ্যভাবে বাজার মূলধন বাড়াতে পেরেছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ব্যাংকটির বাজার মূলধন ছিল ৮ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের ২৮ ডিসেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮২২ কোটি টাকায়। এক বছরে ব্যাংকটির বাজার মূলধন বেড়েছে ৪ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।

ভোগ্যপণ্য খাতের ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের বাজার মূলধনও ইতিবাচক ধারায় ছিল। গত বছরের শেষে যেখানে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৭ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, সেখানে সর্বশেষ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকায়—অর্থাৎ এক বছরে বেড়েছে ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। পাশাপাশি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের বাজার মূলধন প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ১০ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের ২৮ ডিসেম্বর দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকায়।

সব মিলিয়ে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর দরপতনই চলতি বছর শেয়ারবাজারের দুর্বলতার প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এবং বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে এসব শীর্ষ কোম্পানির ব্যবসায়িক ও আর্থিক সক্ষমতার ওপর আস্থা পুনর্গঠন করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 1 day আগে

Leave A Reply

Exit mobile version