অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই–সেপ্টেম্বর) শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, তিন মাসে দেশের বৈদেশিক ঋণ কমেছে ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৪৫ কোটি ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারে। আগের প্রান্তিক অর্থাৎ জুন শেষে এই পরিমাণ ছিল ১১৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সরকারি ও বেসরকারি—উভয় খাতেই বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ কমেছে, যা সামগ্রিক ঋণচিত্রে স্পষ্ট প্রভাব ফেলেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ নেমে এসেছে ৯২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে জুন শেষে তা ছিল ৯৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণও কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ১৯ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, এই পতনের অন্যতম কারণ বায়ার্স ক্রেডিটের উল্লেখযোগ্য সংকোচন। তাঁর মতে, আমদানি কার্যক্রম কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বায়ার্স ক্রেডিটের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও সেই ইঙ্গিতই দেয়। আলোচ্য তিন মাসে বায়ার্স ক্রেডিট প্রায় ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার কমেছে। সেপ্টেম্বর শেষে এই খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে জুন শেষে তা ছিল ৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট বৈদেশিক ঋণ হ্রাসের একটি বড় অংশই এসেছে বায়ার্স ক্রেডিট কমে যাওয়ার কারণে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বৈদেশিক ঋণ কমার মূল কারণ দুটি—নতুন বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হার কমে যাওয়া এবং বিদ্যমান ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। পাশাপাশি আমদানি-নির্ভর বায়ার্স ক্রেডিট কমে যাওয়ায় মোট বিদেশি ঋণের স্থিতি ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি হ্রাস পেয়েছে।
তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের জন্য ঋণসীমা সংকুচিত করেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির কারণে সেই সীমা ধীরে ধীরে শিথিল করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে বিদেশি ঋণসীমা নিয়ে বড় ধরনের কোনো অনিশ্চয়তা নেই এবং ব্যবসায়ীরা চাইলে সহজেই বৈদেশিক ঋণ নিতে পারবেন।
তবে বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, বিদেশি ঋণের তুলনামূলক সুবিধাজনক সুদের হার সত্ত্বেও নতুন ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে না। বর্তমানে বিদেশি ঋণে সুদের হার গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ দিতে হয় ১২ শতাংশেরও বেশি। খরচের দিক থেকে বিদেশি ঋণ ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি লাভজনক হলেও নতুন বিনিয়োগ কার্যক্রম কম থাকায় ঋণের চাহিদা বাড়ছে না।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মূল সমস্যা সুদের হার নয়, বরং নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে স্থবিরতা। নতুন ব্যবসা না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমে যায়, আর তার সরাসরি প্রভাব পড়ে বায়ার্স ক্রেডিটের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাস শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে নিম্ন। এতে স্পষ্ট হয়, নতুন ব্যবসা সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কম থাকায় ব্যাংক ঋণের চাহিদাও দুর্বল রয়েছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, সামনে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনিশ্চয়তা থাকায় নির্বাচনপূর্ব সময়ে নতুন ঋণ নেওয়ার প্রবণতা সীমিত থাকতে পারে। তবে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে আবারও বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ কার্যক্রমে গতি ফিরতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে

