অর্থকাগজ প্রতিবেদন 
জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪ শতাংশের আশপাশে নেমে আসা এবং মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ এক অংকে আটকে থাকার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এমন এক অর্থনৈতিক পর্যায়ে প্রবেশ করছে, যাকে অর্থনীতিবিদরা ‘মাঝারি মাত্রার স্ট্যাগফ্লেশন’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। এই পরিস্থিতিতে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে এবং একই সঙ্গে দেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির ভিত্তিও দুর্বল হয়ে পড়ছে—যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য একটি সতর্ক সংকেত।

গত বুধবার ঢাকায় আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা এই বাস্তবতা তুলে ধরেন। তারা বলেন, বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি মন্দার মধ্যে না পড়লেও স্থায়ী মূল্যস্ফীতি, মজুরি বৃদ্ধির স্থবিরতা, কর্মসংস্থানের অবনমন—বিশেষ করে নারী শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে—এবং দুর্বল বেসরকারি বিনিয়োগ একত্র হয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক দুষ্টচক্র’ তৈরি করেছে।

বেসরকারি গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণ সংস্থা ‘ভয়েস ফর রিফর্ম’ ও ‘ব্রেইন’-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনসহ একাধিক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অংশ নেন।

অর্থনীতিবিদরা ব্যাখ্যা করেন, স্ট্যাগফ্লেশনের বৈশিষ্ট্য হলো—উচ্চ বেকারত্ব ও দুর্বল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কমে না। বিপরীতে, সাধারণ মন্দার সময় চাহিদা কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি সাধারণত নিম্নমুখী হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মাঝামাঝি এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে ‘টেক্সটবুক স্ট্যাগফ্লেশন’—অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি—তুলনামূলকভাবে বিরল। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেন, “বাংলাদেশের মতো দেশে স্ট্যাগফ্লেশন তখনই দেখা দেয়, যখন প্রবৃদ্ধি তার দীর্ঘমেয়াদি গড়ের অনেক নিচে নেমে যায়, কিন্তু মূল্যস্ফীতি উচ্চই থেকে যায়। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, গত তিন থেকে চার বছর ধরে বাংলাদেশে স্ট্যাগফ্লেশনের লক্ষণ স্পষ্ট।”

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন সতর্ক করে বলেন, স্থায়ী মূল্যস্ফীতি, দুর্বল বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বাড়তে থাকা বৈষম্যের সমাধান না হলে বাংলাদেশ ‘নিম্নমাত্রার অর্থনৈতিক সমতা’র ফাঁদে আটকে পড়তে পারে। তার ভাষায়, মূল্যস্ফীতি দুই অংক থেকে নেমে ৮.২৯ শতাংশে এলেও মজুরি বৃদ্ধির গতি প্রায় থমকে থাকায় মানুষের প্রকৃত আয় ও ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে।

জাহিদ হোসেনের মতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৫ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে থাকলেও মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ এক অংকে রয়ে গেছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে তিনি মুদ্রার বিনিময় হার অবমূল্যায়ন ও দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা উল্লেখ করেন। ফাহমিদা খাতুন যোগ করেন, প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত—প্রথমে কোভিড-১৯–জনিত সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্ন, এরপর বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এ চাপকে আরও তীব্র করেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মনজুর হোসেনও এ মূল্যায়নের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত টানা ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার লক্ষ্য বাস্তবতায় অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তার মতে, নির্দিষ্ট প্রবৃদ্ধির সংখ্যার পেছনে ছোটা নয়; বরং অর্থনীতির ভিত্তি পুনর্গঠন, সামষ্টিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং মানসম্মত বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত নীতিগত অগ্রাধিকার।

অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বর্তমানে দেশের জিডিপির আকার প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০৩৫ সালের মধ্যে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছাতে হলে আগামী এক দশক ধরে গড়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে—যা বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বড় চ্যালেঞ্জ।

জাহিদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য হলেও তা একা যথেষ্ট নয়। তার মতে, সামষ্টিক স্থিতিশীলতার তিনটি মূল স্তম্ভ হলো—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক ভারসাম্য রক্ষা এবং আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার।

তিনি বিশেষভাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির কাঠামোগত কারণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সরবরাহ শৃঙ্খলে চাঁদাবাজি এবং চাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ মূল্যস্ফীতিকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। তার ভাষায়, চাঁদাবাজি কার্যত এক ধরনের অদৃশ্য কর, যা স্থায়ীভাবে পণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, অর্থনৈতিক ফলাফল শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপরই নির্ভরশীল—কারণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভেরিয়েবলগুলো ‘রাজনীতির মাটিতেই জন্ম নেয়’। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলেই যে সব অর্থনৈতিক সংকট আপনা-আপনি কেটে যাবে, এমনটি ভাবার সুযোগ নেই।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের ধীরগতি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে গুরুতরভাবে সীমিত করছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৩–২৪ শতাংশে থাকলেও ২০২৪–২৫ অর্থবছরে তা কমে ২২.৫ শতাংশে নেমেছে। তার মতে, উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য ন্যূনতম বিনিয়োগ হার হওয়া উচিত জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ, আর উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে তা ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি নিতে হবে।

তবে ইতিবাচক দিক হিসেবে জাহিদ হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি, অবৈধ অর্থপাচার হ্রাস এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের ফলে বৈদেশিক ভারসাম্যে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বর্তমান ‘সফট পেগ’ বিনিময় হার নীতি মুদ্রাবাজারে অতিরিক্ত অস্থিরতা কমাতে সহায়তা করছে।

ফাহমিদা খাতুন শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর তথ্য তুলে ধরে বলেন, দেশে মোট কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় ১৭ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৪০ হাজার—অর্থাৎ প্রায় ৯৪ শতাংশই নারী। তার মতে, এই প্রবণতা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিশ্বব্যাংক ও পিপিআরসির জরিপ উদ্ধৃত করে তিনি জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য—দুটিই বেড়েছে। এক ধরনের বিরোধাভাস তৈরি হয়েছে, যেখানে শিক্ষার স্তর বাড়লেও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কমছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও শ্রমবাজারের চাহিদার মধ্যে তীব্র অসামঞ্জস্যই এর প্রধান কারণ।

সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি

আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ফাহমিদা খাতুন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাদের ইশতেহারে সুস্পষ্ট সংস্কার কর্মসূচি তুলে ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজনীয় হলেও প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

জাহিদ হোসেন বলেন, প্রতিটি কাঠামোগত সংস্কারেই বিজয়ী ও পরাজিত পক্ষ থাকে। যারা বর্তমান ব্যবস্থায় সুবিধা ভোগ করছে, তারাই সাধারণত সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই সংস্কারের রাজনৈতিক-অর্থনীতিকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করাই হবে সামনে এগোনোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অকা/প্র/ই/দুপুর/২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 4 days আগে

Leave A Reply

Exit mobile version