অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
অর্থনৈতিক চাপ, বাজারের অনিশ্চয়তা ও অর্থায়ন সংকটের কারণে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত বর্তমানে তীব্র চাপের মুখে রয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা জানান, তাদের বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে এবং ফিজিক্যাল দোকান বা শোরুমের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় এসএমই পণ্য মেলায় প্রায় ৪০ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের প্রায় সবাই নিশ্চিত করেছেন, অর্থনৈতিক চাপ, বাজারের অস্থিরতা ও তীব্র অর্থ সংটের কারণে সম্প্রতি তাদের ব্যবসা কমে গেছে। এই পরিস্থিতির কারণে অনেকেই ২০২৫ সাল নিয়ে তেমন কোনো আশার আলো দেখছেন না, বরং ২০২৬ সালকে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাব্য বছর হিসেবে বিবেচনা করছেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের আয়োজনে গত ৭ ডিসেম্বর ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে ৩৫০টিরও বেশি এসএমই প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় এসএমই পণ্য মেলায় সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, কোভিডের পর ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু পরবর্তীতে শোরুম ভাড়া ও কর্মীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মাহমুদা বলেন, 'আমার ব্যবসা অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। আমি নিজেও কেনাকাটা কমিয়েছি।' এই পরিস্থিতির জন্য তিনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু জীবনযাত্রার সামগ্রিক ব্যয় অনেক বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেশি খরচ করার সক্ষমতা রাখা এক শ্রেণির ক্রেতা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দামি বা শৌখিন পণ্যের বেচাকেনায়।
আরেকটি বড় বাধা হলো অর্থায়নের সুযোগ। মাহমুদা এর আগে ব্যাংকের ১০ লাখ টাকার একটি ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু এখন ব্যবসা খারাপ হওয়ায় ১৫ লাখ টাকা ঋণের জন্য আবেদন করছেন। কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করেও এখনো সেটি পাননি।
অন্য উদ্যোক্তারাও একই সুরে কথা বলেন। বাহারি রং-এর স্বত্বাধিকারী ইলোরা পারভীন বলেন, 'কেনাকাটা এখন খুবই কম। পরিচিত অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ অনলাইনে কোনোরকমে টিকে আছেন। ...এমনকি মেলায়ও বেচাকেনা হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি কবে ঠিক হয় বলা যায় না।'
চট্টগ্রাম থেকে আসা ইজিস শিল্ড-এর স্বত্বাধিকারী শাহিনা আক্তারও বলেন, 'এখন মানুষ টাকা কম খরচ করছে। মানুষের কাছে টাকা হয়তো আছে, কিন্তু বাজারে ছাড়ছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্ট্যাবল হলে হয়তো ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়াবে।'
ডিজাইন বাই রুবিনা-র স্বত্বাধিকারী রুবিনা আক্তার মুন্নি ভ্যাট, কমপ্লায়েন্স ও ট্রেড লাইসেন্স-সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'আমি গাজীপুরে ফ্যাক্টরি সরানোর পর ট্রেড লাইসেন্স করতে দুই মাস ঘুরেছি। যারা লাইসেন্স দেন, তারা এসএমই বোঝেন না। এক আইনজীবী ব্যর্থ হয়েছেন, পরে আরেকজন কষ্টে লাইসেন্স করিয়েছেন।'
শাহিনা আক্তারসহ বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, দেশের এসএমই ইকোসিস্টেম প্রায় পুরোপুরি ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে রাজধানীর বাইরের উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, কাঁচামাল সংগ্রহ এবং দাপ্তরিক কাজের জন্য প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে ঢাকায় আসতে হয়, যা তাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য।
আহ্লাদ ফ্যাশনস-এর স্বত্বাধিকারী এবং এ বছর মাইক্রো ক্যাটাগরিত সেরা উদ্যোক্তার পুরস্কারজয়ী জুয়েনা ফেরদৌস মিতুল পণ্যকে আন্তর্জাতিক মানের করে তোলার জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন। পাশাপাশি তিনি রফতানির ক্ষেত্রে নথিপত্র-সংক্রান্ত জটিলতার সমালোচনা করেন, রফতানি বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করে।
প্রিমিয়াম চা ও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা উদ্যোক্তা জান্নাতুল মাওয়া নারী উদ্যোক্তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে পারিবারিক সমর্থনের অভাব, মূলধন সংকট ও লাইসেন্স-সংক্রান্ত জটিলতার কথা বলেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীও বিশেষ করে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে গ্রামীণ নারী ও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন বা ঋণ পাওয়া একটি বড় বাধা। ডকুমেন্টেশন সমস্যা, দক্ষতার ঘাটতি ও 'ব্যাংকারদের অনীহার' কারণে তারা প্রায়ই প্রয়োজনীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন।
তিনি আরও বলেন, ২০০৭ সালে ২০০ কোটি টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করা ফাউন্ডেশনের নিজস্ব তহবিলও সীমিত। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে ঋণের সুদে কিছু ভর্তুকি দেওয়া হলেও, তিনি স্বীকার করেন যে 'প্রকৃত প্রান্তিকরা খুব কমই এই সুবিধা পান'।
আনোয়ার হোসেন আরও উল্লেখ করেন, কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এবং পর্যাপ্ত আঞ্চলিক কেন্দ্র না থাকায় দূরবর্তী এলাকায় সেবা পৌঁছে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
পণ্যের মানোন্নয়ন ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ দুর্বলতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ছোট উদ্যোক্তাদের অনেকেই মানসম্পন্ন কাঁচামাল দেশে পাচ্ছেন না। বড় শিল্পগুলো যেসব সুবিধা পায়, ছোটদের জন্য তা নেই। এ কারণে তারা বিদেশি কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। নীতিগত সহায়তা ছাড়া এই খাত টেকসইভাবে দাঁড়াতে পারবে না।'
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ অনুযায়ী, জাতীয় জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ; শিল্প খাতে এই হার ৩৭.৯৫ শতাংশ। তবে এসএমই ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এই হার বেশ কম। যেমন ভারতে এই অবদান প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৪০ শতাংশ।
ফাউন্ডেশন মনে করে, সঠিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে এসএমই খাতের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব।
বর্তমান সংকট সত্ত্বেও উদ্যোক্তাদের মধ্যে একধরনের সতর্ক আশাবাদ রয়েছে। নতুনত্ব বুটিক অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফটস-এর হাসিনা মুক্তা বলেন, ব্যবসার সহায়তায় অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পর আগামী বছর সেগুলোর ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে।
ডিজাইন বাই রুবিনার রুবিনা আক্তার মুন্নি মনে করেন, ২০২৬ সাল এই খাতের জন্য, বিশেষ করে চামড়া, পাট ও সিরামিক শিল্পের জন্য বড় সুযোগ নিয়ে আসতে পারে। ●
অকা/ক্ষুওমাশি/ই/সকাল/১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 hours আগে

