অর্থকাগজ প্রতিবেদন

ডিজিটাল ব্যাংক করতে হলে প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ৫০০ কোটি টাকা পেইড আপ ক্যাপিটাল দিতে হতে পারে। এছাড়া এসব ব্যাংকের লাইসেন্স ব্যাংক-কোম্পানী আইনের আওতায় দেওয়ার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে ডিজিটাল ব্যাংক নিয়ে প্রস্তাবিত এক প্রাথমিক নীতিমালায়।

ব্যাংক এশিয়া এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান 'নগদ' এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডিজিটাল ব্যাংক করার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছে। এসব প্রস্তাবনার ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। নগদ ছাড়াও বেশ কয়েকটি এমএফএস প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংক চালু করতে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল সম্প্রতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে ব্যাপক ও দ্রুততর করার লক্ষ্যে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর বিষয়টি পরীক্ষা করা হবে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এমন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে তরুণ আইটি কর্মীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ডিজিটাল ব্যাংক কেমন হতে পারে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ ব্যাংক মূল লেনদেনগুলো ব্রাঞ্চের মাধ্যমেই করে থাকে। পাশাপাশি তারা গ্রাহকদের অনলাইনে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে। নতুন এই ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর কোনো ব্রাঞ্চ অফিস (শাখা) থাকবে না। তাদের একটি প্রধান অফিস থাকবে। তারা মূলত ওয়েবসাইট ও এ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা দেবে। সেইসঙ্গে লেনদেন বা গ্রাহকের সমস্যা সমাধানে তারা কল সেন্টার চালু করবে। পুরোদমে চালু হলে সাধারণ ব্যাংকের মতোই বড় অংকের লেনদেন করতে পারবে ডিজিটাল ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য নতুন আইন করা কঠিন। কারণ, বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানী আইন অনুযায়ী একটি নতুন ব্যাংক চালু হতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মতো সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে নতুন আইন করে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হলে সময় লাগবে অন্তত দুই-তিন বছর। এটি যেহেতু একটি ব্যাংক, তাই ব্যাংক-কোম্পানী আইন অনুযায়ীই সেটি পরিচালিত হতে পারে। এমন হলে যারা ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, তাদেরকে সাধার‌ণ ব্যাংকের মতো করেই ৫০০ কোটি টাকা পেইড আপ ক্যাপিটাল দিতে হবে।

ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় নীতিমালা প্রণয়নে বেশ কয়েক মাস ধরেই কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে প্রায় 8 মাস আগে অন্য দেশগুলোতে কীভাবে ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রসার লাভ করেছে এবং বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং কেমন হতে পারে জানতে একটি কমিটি করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে অন্তত ৬-৭টি সভা শেষে মাসখানেক আগে প্রস্তাবনা আকারে একটি প্রাথমিক নীতিমালা জমা দিয়েছে।

গত কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে আরেকটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। নতুন এই কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের পর ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

'ডিজিটাল ব্যাংক কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে' এ সিদ্ধান্ত নিতে বিদেশে থাকা ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠার ধরন ও কাজ করা পদ্ধতি আমলে নিয়েছে আগের কমিটি। সে অনুযায়ী বিশ্লেষণ করেই তারা প্রস্তাবনা প্রতিবেদন দিয়েছিল। নীতিমালা প্রণয়নে কাজ চললেও ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আরো বেশকিছু সময় লাগবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'সিঙ্গাপুর, ভারতসহ অনেকগুলো দেশেই ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রচলিত আছে। এসব দেশের পদ্ধতিগুলো আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি। দেশগুলোতে একটি ডিজিটাল ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়ার পর সাধারণত তিনটি ধাপে তাদের আওতা বাড়ানো হয়।

প্রথম ধাপে তাদেরকে রিটেইল ব্যাংকিং এর অনুমতি দেওয়া হয়। এই ধাপে ব্যাংকগুলো কাস্টমারদের কাছে থেকে ডিপোজিট জমা ও তোলা, ছোট লোন এবং এক একাউন্ট থেকে আরেক একাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফারের মতো বিষয়গুলো করে থাকে। এইরকম অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে মনিটর করা হয়। যদি তারা এসব কাজগুলো সফলতার সঙ্গে করতে পারে, তবে তাদেরকে দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়।

এই ধাপে ব্যাংকগুলো স্মল, মিডিয়াম ও মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ খাতে ঋণ দিতে পারে। ব্যাংকগুলোর তখন প্রোডাক্ট ভ্যারিয়েশন বাড়ে। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো কোম্পানীতে রূপান্তরিত হয়।

তৃতীয় ধাপে ব্যাংকগুলো হোলসেল বা কর্পোরেট ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। এসময় ডিজিটাল ব্যাংকগুলো অন্য সাধারণ তফসিলি ব্যাংকের মতো এক্সপোর্ট রিসিভ করা, ইমপোর্ট পেমেন্ট করা, এলসি খোলাসহ বড় আকারে ঋণ দিতে পারে।'

কমিটি তাদের প্রস্তাবনায় দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোর মতোই ধাপে ধাপে এগোনোর পরামর্শ দিয়েছে। তবে তারা দ্বিতীয় ধাপটি বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। এর বাইরে, প্রথম ধাপটি কতদিনের জন্য হবে, এ নিয়ে কমিটির সদস্যরা একমত হতে পারেননি। কমিটির বেশিরভাগ সদস্যই ধাপটি অন্তত দুই-তিন বছর করার পক্ষে মত দিয়েছেন।

ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রোডাক্ট কীভাবে ডেলিভারি দিবে, ব্যাংকের এবং অর্গানাইজেশনের কাঠামো কেমন হবে, ব্যাংক কোম্পানী আইনে হবে নাকি নতুন কোনো আইন হবে ইত্যাদি বিষয়েও রিপোর্টটিতে মতামত দিয়েছেন কমিটির সদস্যরা।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের চূড়ান্ত নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলমান আছে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, 'এখনো কোনোকিছু ঠিক হয়নি। তবে কাজ চলমান আছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করতে আরো উচ্চপদস্থ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নতুন আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কমিটি আগের প্রস্তাবিত প্রাথমিক নীতিমালা দেখে সেটি সংশোধনে পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন। ফলে, আগের কমিটির জমা দেওয়া প্রস্তাবনার অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে।'

নগদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাহেল আহমেদ বলেন, 'বর্তমানে আমাদের সাড়ে ৬ কোটি গ্রাহককে মূলত পেমেন্ট সার্ভিসগুলোই আমরা দিচ্ছি। তবে ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে পেমেন্ট একটা সাইড। এছাড়াও সেভিংস, লোনসহ আরো অনেক কাজ আছে ব্যাংকের। এই জায়গাগুলোতে আমরা কাজ করতে পারবো। একটি ব্যাংককে ব্রাঞ্চ করতে হয়, এজেন্ট ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রেও ন্যূনতম একটি ব্রাঞ্চ লাগে। ডিজিটাল ব্যাংকের এরকম বাধানিষেধ নেই।'

ডিজিটাল ব্যাংকিং অন্য অনেক দেশেই প্রচলিত আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা আসলে একটা ক্যাশলেস সোসাইটি নির্মাণ করতে চাইছি। ইতিমধ্যে সারা দেশেই নগদের এজেন্ট এবং ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল রয়েছে, গ্রাহকেরা টাকা জমা দেওয়া ও তোলার ক্ষেত্রে এমএফএস-এর এসব সুবিধা পাবে। ডিজিটাল আরেকটি বিকল্প চ্যানেল করার পরিকল্পনাও আছে আমাদের।

সাধারণ ব্যাংকিং এর সঙ্গে ডিজিটাল ব্যাংক কোনো দ্বন্দ্ব তৈরী করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি না এটা কোনো কনফ্লিক্ট (দ্বন্দ্ব) তৈরি করবে। এখন যে সনাতন ব্যাংকিং আছে, সেটা চলতে থাকবে। দেশের ৩৫% জনগণ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, আমরা প্রথমেই তাদের ডিজিটাল ব্যাংকিং এর আওতায় নিয়ে আসতে চাই। পরে আমরা আরো পরিণতভাবে ব্যাংকিং সেবা চালু করার পরিকল্পনা করেছি।'

#

অকা/ব্যাংখা/দুপুর, ১২ জুন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 3 years আগে

Leave A Reply

Exit mobile version