অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
অব্যাহত জ্বালানি সংকট, ব্যবসার পরিচালনার ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং চালান পাঠাতে দেরীর কারণে সক্ষমতার চেয়েও নিচে কারখানা চালাতে বাধ্য হচ্ছেন পোশাক রফতানিকারকরা। এমন অবস্থায়, তাদের রফতানি কার্যাদেশ ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এসময়ে তাঁদের উৎপাদন ব্যয় ২০ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়লেও – বৈশ্বিক ক্রেতারা তার চেয়েও ২০ শতাংশ পর্যন্ত কম দরের প্রস্তাব দিচ্ছে। ফলে অনেকেই অর্ডার নিতেও পারছেন না।
এদিকে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো পোশাকখাতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশের ব্যবসায়ীরা – তাদের স্থানীয় মুদ্রার অনুকূল বিনিময় হার ও দ্রুত চালান পাঠানোর সক্ষমতার কারণে – কম দরে কার্যাদেশ নিতে রাজি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের বদলে এসব দেশে রপ্তানি অর্ডার দিচ্ছে বায়াররা।
বাংলাদেশের পোশাক রফতানির মূল বাজার পশ্চিমা দেশগুলোতে। যেখানে শীতকালে বিক্রিবাট্টার সর্বোচ্চ মৌসুম বা পিক সিজন। দেশের বৃহত্তম রফতানি খাত এবারের পিক সিজনে পশ্চিমা বাজারগুলোয় বিক্রিতে ৭ শতাংশ ধসের আশঙ্কা করছে। আর এমন সময়ে তা করা হচ্ছে, যখন সরকার প্রণোদনার হার অনেকটাই কমিয়েছে। তাছাড়া, রফতানির সংশোধিত তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, আগের ১০ মাসে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
এ বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের অর্ডার বুকিং নিয়ে যারা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন– তাদের মধ্যে আছেন, এবছরের সর্বোচ্চ রফতানির ট্রফি জয়ী থেকে শুরু করে পরিবেশবান্ধব কারখানা প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত এবং ডেনিম উৎপাদনের অগ্রণীরা।
উইন্ডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ উদ্দিন খান জানান, উৎপাদন খরচের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কম দরের প্রস্তাব দিচ্ছে ক্রেতারা। এতে কার্যাদেশগুলো নিতে পারছেন না তিনি। ফলে তার ব্যবসা এক নেতিবাচক প্রবণতার মধ্যে রয়েছে।
'এবছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়ের জন্য ২০ শতাংশ কার্যাদেশও নিশ্চিত করতে পারেনি উইন্ডি গ্রুপ। এদিকে ফল হলিডে সিজনের অর্ডার পাওয়ার সময় শেষ হয়ে গিয়েছে' - বলছিলেন মেসবাহ, যিনি গতকাল রোববার তৈরি পোশাক (ওভেন) খাত থেকে সর্বোচ্চ রফতানির জন্য স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে।
বিশ্বের প্রথম এলইইডি প্ল্যাটিনাম সনদপ্রাপ্ত ডেনিম কারখানা হলো এনভয় টেক্সটাইলের। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বায়ারদের দাম অনুযায়ী উৎপাদন করতে গিয়ে টেক্সটাইল মিলগুলো প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আছে। কখনও কখনও আমাদের দাম সামঞ্জস্য করতে হয়, কস্ট ম্যানেজ করার জন্য স্পিনিং ইউনিটকে কাজে লাগাতে হচ্ছে।'
তার কারখানা এপ্রিল মাসের জন্য পূর্ণ কার্যাদেশের বুকিং পেয়েছিল, কিন্তু আগামীতে কী হবে জানেন না তিনি।
বাংলাদেশ থেকে ডেনিম রফতানির একটি পথপ্রদর্শক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভির বলেন, 'বায়ারদের দাম অনুযায়ী, প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আমরাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। বাংলাদেশের চেয়ে স্থানীয় মুদ্রার বেশি অবমূল্যায়ন হওয়ায়– কম দরে অর্ডার নেওয়ার দিক থেকে সুবিধেজনক অবস্থানে আছে পাকিস্তান ও তুরস্কের রপ্তানিকারকরা।'
দুই ডজনেরও বেশি পোশাক রফতানিকারকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের তুলনায় তারা এই বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়কালে রফতানি কার্যাদেশে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমার কথা জানিয়েছেন। মূল কারণ হিসেবে জানান, আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও রিটেইলার প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক রফতানিকারকদের নিম্ন দর প্রস্তাব করায়– বেশিরভাগের পক্ষেই অর্ডার নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারা যে দাম দিতে চেয়েছে – তাতে উৎপাদনের খরচও বহন করা সম্ভব নয়– কোনো কোনো রফতানিকারকের এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ-ভিত্তিক এমকে নিট ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "উৎপাদনের ব্যয় বাড়লেও– প্রায় সকল বায়ার পোশাকের দাম ১২ থেকে ১৫ শতাংশ কমাচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে তারা এক বছর আগের চেয়েও কম দর হাঁকছে, ফলে আমরা একেবারে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছি।"
তিনি বলেন, "এক বছর আগেও একটি পোলো টিশার্ট বিক্রি হয়েছে ৪ ডলারে; সেই পণ্য কেনা একই বায়ার এখন সাড়ে ৩ ডলার বলছে। এই অবস্থায়, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে অর্ডার নেওয়ার চেয়ে- স্বল্প সক্ষমতায় হলেও কারখানা চালু রাখা ভালো।"
হাতেম সাধারণত মাসে দেড় মিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি করতেন, যা এখন কমে ৭ লাখ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের-ও নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, "ব্রেক ইভেনে থাকতে সক্ষমতার অন্তত ৮০ শতাংশে পোশাক কারখানা চালু রাখতে হয়, কিন্তু এখন বেশিরভাগই ৬০ শতাংশ সক্ষমতায় চালু আছে।"
টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, "বায়াররা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দর অফার করছে। পশ্চিমা বাজারে নিম্ন চাহিদার কথা উল্লেখ করে তারা তাঁদের বিক্রিবাট্টা কমে যাওয়ার কথা বলছে।"
রফতানি কার্যাদেশ কমার জন্য যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রিবাট্টা হ্রাস; এবং একইসঙ্গে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বেশি ইনভেন্টরি থাকাকে দায়ী করছেন রফতানিকারকরা।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে প্রধান প্রধান সব বাজারেই পোশাক আমদানি ২ শতাংশ কম হয়েছে।
অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান বাজারগুলোয় পোশাকের খুচরা বিক্রিও কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের একই মাসের তুলনায়– চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে তা ১ শতাংশ কমেছে, যুক্তরাজ্যে কমেছে ৩ শতাংশ।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "প্রধান বাজারগুলোয় স্বল্প চাহিদার কারণে অর্ডার প্লেসমেন্টের গতি নেই, তাছাড়া, বায়াররা দামও কম দিতে চাচ্ছে।"
আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, লোহিত সাগরে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বেড়েছে জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যয়; এদিকে গ্যাস, বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে, বেড়েছে শ্রমিকদের মজুরি– এসব মিলিয়ে সার্বিক উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। কিন্তু, বায়াররা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দর দিচ্ছে না, একারণে বেশিরভাগ কারখানা তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী অর্ডার নিতে পারছে না। অর্ডার বুক করতে ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানাগুলো বেশি সমস্যার মধ্যে রয়েছে বলেও যোগ করেন তিনি।
শোভন জানান, আরও ভালো প্রণোদনার সুবিধা এবং অনুকূল মুদ্রার বিনিময় হার থাকায়– কম দর দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত ও শ্রীলঙ্কার রপ্তানিকারকরা আমাদের চেয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে, এজন্য বায়াররাও সেখানে চলে যাচ্ছে।
শোভন ইসলাম বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ'র-ও একজন পরিচালক। বাংলাদেশ থেকে সময়মতো রফতানির চালান পাওয়ার বিষয়ে বায়ারদের মধ্যে যে শঙ্কা কাজ করে– সেটিও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, "এজন্যই কিছু শীর্ষ বায়ার ভিয়েতনাম, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় তাঁদের অর্ডার নিয়ে যাচ্ছে।"
গ্যালপেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রেজাউল আলম বলেন, "উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও, বিনিময় হারে ডলারের দর বাড়ায় কিছু ক্রেতা দাম কমাচ্ছে।" তবে ২০২৫ সাল নাগাদ ব্যবসার পরিস্থিতিতে উন্নতি হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
নাম না প্রকাশের শর্তে একটি ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, (বাংলাদেশের) কারখানাগুলো এখন যে অর্ডার পাচ্ছে, তার চেয়ে উচ্চ সক্ষমতা তাদের রয়েছে। এমতাবস্থায়, টিকে থাকার স্বার্থেই বড় সক্ষমতার কিছু কারখানা যেকোনো দরে অর্ডার নিচ্ছে, অন্যদিকে ছোট ও মাঝারি কারখানা তা-ও করতে পারছে না।
বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এজন্য চলমান বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে যুদ্ধ-সংঘাতকেও অনেকাংশে দায়ী করেন, যা ভোক্তাদের আস্থায় অনেকখানি চিড় ধরিয়েছে।
সিদ্দিকুর বলেন, দেশে যখন গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট অব্যাহত আছে, তার মধ্যেই নগদ প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত রফতানিকারকদের প্রতিযোগী সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, এতে চালান পাঠাতে বিলম্ব হচ্ছে আর উৎপাদন ব্যয়ও অনেকটা বেড়ে গেছে।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলতে– বিকল্প কোনো প্রণোদনা চালুর আগপর্যন্ত নগদ প্রণোদনা সহায়তা আগের হারে পুনর্বহাল করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ●
অকা/তৈপোশি/সৈই/সকাল/১৫ জুলাই, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 year আগে

