অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
প্রান্তিক খামারিরা মুরগি বা ডিমে লাভ করতে পারছেন না। একদিকে দাম কম, অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বেশি। নতুন করে বেড়েছে ফিড (খাবার) এবং ওষুধের দাম।
অন্যদিকে অধিক মুনাফার আশায় উৎপাদন সমতা বাড়িয়েছেন হ্যাচারির মালিকেরা। তাতে এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। তার বিপরীতে চাহিদা বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। ফলে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেড়ে যাওয়ায় মুরগির বাচ্চার দাম কমে এখন নেমেছে ১০ থেকে ২০ টাকায়।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। সেখানে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২ কোটি। সোনালি ও রঙিন জাতের বাচ্চার উৎপাদন আড়াই কোটি ছাড়িয়েছে। এ ধরনের বাচ্চার চাহিদা সপ্তাহে ২ কোটি ১০ লাখ। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকায় মুরগির বাচ্চার দাম পড়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে দামের এমন নিম্নমুখী প্রবণতাকে অস্বাভাবিক মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ কারণে লোকসানের মুখে ছোট হ্যাচারিগুলো হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে, বলছেন হ্যাচারি বা খামারের মালিকেরা। এ বিষয়ে বিএবির সাধারণ সম্পাদক শাহ ফাহাদ হাবিব বলেন, ‘গত এপ্রিল থেকে বাজারে মুরগির বাচ্চার দাম কম। যার মূল কারণ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি। গত বছর দাম বেশি থাকায় সবাই উৎপাদন বাড়িয়েছেন। এখন সপ্তাহে ২ কোটি ৩০ লাখের বেশি বাচ্চা উৎপাদিত হচ্ছে। চাহিদা কমলেও হুট করে উৎপাদন কমানোর সুযোগ নেই।’
হ্যাচারি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে প্রতিটি ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনে খরচ ৩৫ থেকে ৪০ টাকা; কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকায়। যদিও সরকার নির্ধারিত মূল্য ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। একইভাবে লেয়ার বাচ্চা ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৪৭ টাকা। এ ছাড়া সোনালি জাতের প্রতিটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে ২০ থেকে ৩০ টাকা খরচ হলেও এসব বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়।
প্ল্যানেট এগ লিমিটেডের সপ্তাহে ২ থেকে আড়াই লাখ বাচ্চা উৎপাদনের সমতা রয়েছে। এ খামারে প্রতিটি মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ গড়ে ৪৫ টাকা; কিন্তু তারা বিক্রি করছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। ফলে প্রতিটি বাচ্চায় ২৫ থেকে ৩০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। মাসে ১০ লাখ বাচ্চা উৎপাদনের বিপরীতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শাহ ফাহাদ হাবিব।
হ্যাচারিমালিকেরা বলছেন, ভয়াবহ দরপতনে অনেক ছোট ও মাঝারি হ্যাচারি বা খামার এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার, হ্যাচারিমালিক ও খামারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। যারা প্রতি তিন মাস পরপর মুরগির বাচ্চার চাহিদা পর্যালোচনা করে উৎপাদনের ল্যমাত্রা ঠিক করবেন। যাতে বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ না থাকে। এ জন্য প্রয়োজনে হ্যাচারির উৎপাদনের তথ্যভিত্তিক নিবন্ধনব্যবস্থা তৈরির প্রস্তাব দেন তাঁরা।
দেশে এখন তালিকাভুক্ত হ্যাচারি রয়েছে প্রায় ৫০টি। যার মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সমতা অনেক বেশি। আর তিনটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনমতা দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ। দাম পড়ে যাওয়ায় তাদের লোকসানও বেশি।
কোয়ালিটি ব্রিডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে দামের এই নিম্নমুখী প্রবণতা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ কারণে অনেক ছোট ছোট হ্যাচারি এখন বন্ধের পথে। অনেক দিন ধরেই হ্যাচারিমালিকেরা উৎপাদন নিয়ে নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় আসতে পারছেন না। বড়দের বেশি লোকসান হচ্ছে। হয়তো তারা ছোটদের সরিয়ে দিতে ইচ্ছাকৃতভাবেও এমনটা করছেন। এখানে সরকারের হস্তপে দরকার।
মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের েেত্র প্রথম ধাপে বিদেশ থেকে জিপি বা গ্র্যান্ড প্যারেন্ট নিয়ে আসা হয়। এসব জিপি থেকে পিএস বা প্যারেন্ট স্টক উৎপাদিত হয়। আর এসব পিএস থেকে নিয়মিত ডিম পাওয়া যায়, যা দিয়ে এক দিনের মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। নেদারল্যান্ডসের প থেকে ২০২৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় এ দেশের মুরগির বাজার নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশে ব্রয়লারের জিপি মার্কেটের ৩৮ শতাংশের মালিকানা ছিল কাজী ফার্মের হাতে। সিপি ও নারিশের মালিকানায় ছিল যথাক্রমে ১৭ ও ১৬ শতাংশ বাজার। অর্থাৎ তিনটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ বাজার হিস্যা।
এ খাতের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য কাজী ফার্মসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাৎণিকভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
গবেষণার মাধ্যমে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের মৌলিক সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের উপায় নির্ধারণ করে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির মহাপরিচালক শাকিলা ফারুক বলেন, ‘অতিরিক্ত সরবরাহ ছাড়াও এখন বাজারে চাহিদা কমে গেছে। কারণ, খামারিরা লাভ করতে পারছেন না। ফিড ও ওষুধের দামও বেশি; কিন্তু ডিম ও মুরগি বিক্রি করে খামারিরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। লোকসানে থাকায় অনেক খামারি এ ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। এটাও দাম কমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ।’
সরকারি মুরগির খামার রয়েছে ২৮টি। তার মধ্যে ১৫টি খামারে বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এসব খামার থেকে মোট বাচ্চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৮ লাখ। সরকারি খামারের মুরগির বাচ্চার দাম ১২ থেকে ১৫ টাকা। সর্বশেষ সরকারের প থেকে এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল ২০২৩ সালে। এখন বাজারে দাম অস্বাভাবিক পড়ে যাওয়ার কারণ পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ●
অকা/শিল্প/ফর/সন্ধ্যা/১৯ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 months আগে