অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
পাহাড়গুলো এখন সনাতন কৃষি থেকে বের হয়ে আধুনিক কৃষির সাম্রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আর এ প্রচেষ্টার বীজ জোগান দিচ্ছে পাহাড়ে পরিচালিত ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’। এ প্রকল্পের পরিচালক শহিদুল ইসলাম। তিনি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে দেখিয়েছেন কীভাবে সেখানে কাজুবাদাম ও কফিতে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। তবে তিনি এ চাষাবাদকে নিতে চান অনেক দূর। ‘পাহাড়ে যতটুকু চাষ সম্ভব হচ্ছে, এর চেয়েও বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব। আমার প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২১ সালের জুন মাসে শুরু হয়। দেশের ১৯ জেলার ৬৬টি উপজেলায় প্রকল্প কার্যক্রম চলমান। প্রকল্পের শুরুতে দেশে কাজুবাদাম চাষ হতো দুই হাজার ২শ হেক্টর জমিতে। প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে প্রায় চার হাজার ২শ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে।’
একই সঙ্গে ওই সময়ের (২০২১ সাল) কফি চাষ মাত্র ৬৫ হেক্টর থেকে বেড়ে এক হাজার ৮শ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। এ সম্প্রসারণ অধিকাংশই দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় হয়েছে। পাহাড়ে এখনো ৯৮ শতাংশ জমি অনাবাদি। যার প্রায় সবগুলোতে কফি ও কাজুবাদাম চাষ করা সম্ভব। অন্তত কয়েক বছরের মধ্যেই পাহাড়ের এক লাখ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম ও আরও এক লাখ হেক্টর জমিতে কফি চাষ সম্ভব।
পাহাড়ঘেরা বান্দরবানের হর্টিকালচার সেন্টারে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান ‘কিষাণঘর অ্যাগ্রো’। সেখানে কাজ করছেন ১৫-২০ জন নারী, যাদের অধিকাংশ পাহাড়ি। ছোট এ প্রতিষ্ঠানে অবহেলিত পাহাড়ি নারীরা পেয়েছেন ভিন্ন জীবন। জুমচাষ থেকে কৃষক এখন সম্ভাবনাময় কাজু-কফি চাষি। দেশের অর্থনীতিতেও লাগছে বদলের হাওয়া।
চাষাবাদ করলে শুধু উৎপাদন নয়, দেশের পাহাড়িদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সার্বিক রফতানিসহ অনেক পরিবর্তন সম্ভব বলে জানান এ প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, ‘কাজুবাদাম উৎপাদনে একদম যত্নের প্রয়োজন হয় না। একবার গাছ লাগালে হয়ে যায়। ঘরে মাসের পরে মাস সংরণ করা যায়। এটার দাম ভালো। কফিও তাই। এমন উচ্চমূল্যের ফলন কমই আছে।’
সেখানে কথা হয় একজন কফি চাষির সঙ্গে। তিনি জানান, এক কেজি কাজুবাদাম বিক্রি করে তিনি ২০০ টাকা পাচ্ছেন। কফি বীজে পাচ্ছেন ৪শ থেকে ৬শ টাকা। কিন্তু পাহাড়ে এক কেজি আম থেকে হয়তো মাত্র ৪০ টাকা পাওয়া যায়। তাই পাহাড়ি কৃষকরা কফি-কাজুবাদাম ফলনে আকৃষ্ট হচ্ছেন। এছাড়া প্রকল্প থেকে এসব চাষিকে প্রশিণ দেওয়া হচ্ছে। বিনা মূল্যে চারাও পাচ্ছেন তারা।
বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এম এম শাহ্ বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য পাহাড়ি এলাকার ভূ-প্রকৃতির অবস্থান ও আবহাওয়া বিবেচনায় কফি এবং কাজুবাদাম জাতীয় ফসল আবাদের অনেক সুযোগ রয়েছে। যে কারণে প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের এসব ফসল আবাদে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।’
কফি-কাজুবাদাম এ দেশের পুরো অর্থনীতিতে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এসব গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রফতানি। বিশ্বব্যাপী চাহিদা আছে। কাজুবাদাম ও কফির উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ রফতানির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলোর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি দেশে এসব পণ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কৃষি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
কাজুবাদাম ও কফির আবাদ সম্প্রসারণের ফলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। ষাটের দশক থেকে পাহাড়ে কাজুবাদামের চাষ হলেও প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ছিল না। তাই বাণিজ্যিকভাবে চাষে উৎসাহিত হননি কৃষক। কিন্তু লাভজনক হওয়ায় গত কয়েক বছরে দেশে ২২টি বাদাম প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে নিয়মিত উৎপাদনে আছে ১৫টি প্রতিষ্ঠান। যাদের ১০-১২ হাজার টন বাদাম প্রক্রিয়ার সমতা রয়েছে। লাভজনক হওয়ায় বড় করপোরেট গ্রুপগুলোও এ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে।
কিষাণঘর অ্যাগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কাজুবাদাম চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত করছি। প্রথমে ১২০ জন কৃষক নিয়ে চাষাবাদ শুরু করলেও এখন ৯৫০ জন কৃষক বাদাম উৎপাদনে কাজ করছেন।’ ‘দেশে কাজুবাদামের চাহিদা প্রচুর, যার সিংহভাগ এখনো আমদানি হয়। এছাড়া বিদেশে বড় রফতানির বাজার রয়েছে। আমাদের চাষাবাদ আরও বাড়লে ভবিষ্যতে বাদামের ব্যাপক সরবরাহ পাওয়া যাবে। আশা করছি, আমরা রফতানিতেও যেতে পারবো।’
দেশে কাজুবাদামের ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশে বর্তমানে কাজুবাদামের বাজার প্রায় ৭শ কোটি টাকার।
যেখানে স্থানীয় উৎপাদন মাত্র ১শ কোটি টাকার। বাকি ৬শ কোটি টাকার বাদাম আমদানি করতে হয়। যেজন্য বছরে আড়াই হাজার টন থেকে তিন হাজার টন কাজুবাদাম আমদানি হয়। সেটাও প্রতি বছর বাড়ছে।
এদিকে দেশে কফির চাহিদা প্রায় দুই হাজার টন। গত এক দশকে গড়ে কফির চাহিদার প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫৬ শতাংশ। বছরে প্রায় ৬শ কোটি টাকার কফি দেশের অভ্যন্তরে বিক্রি হয়। ভোক্তা পর্যায়ে গত পাঁচ বছরে এ দুটি পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
অন্যদিকে, বিশ্ব বাজারে বিশাল চাহিদা রয়েছে এ দুই কৃষিপণ্যের। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক আয় সম্ভব।
কফি-কাজুবাদাম প্রকল্পের শুরু থেকেই এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলমান। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের দুই লাখ হেক্টর অনাবাদি জমিকে কাজুবাদাম ও কফি চাষের আওতায় আনার কাজ চলমান। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদিত কাজুবাদাম ও কফির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এক বিলিয়ন ডলারের রফতানি করা সম্ভব।
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় শিল্পগোষ্ঠী কফি-কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। প্রাণ, বিএসআরএম ও কাজী গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান রফতানির উদ্দেশ্যে প্রায় ৩শ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করছে। ●
অকা/কৃষি/ফর/রাত/২০ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 months আগে

