অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের দাম কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এলেও দেশের ক্রেতারা এখনো এর সুফল বাস্তবে অনুভব করতে পারছেন না। পাইকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য মূল্যপতন ঘটলেও খুচরা দামের সমন্বয়ে সরকারের দীর্ঘসূত্রতা ভোক্তা বাজারে স্থবিরতা তৈরি করেছে।

গত এক মাসে পাইকারি বাজারে পাম অয়েলের দাম মণপ্রতি ৪৫০ টাকার বেশি কমেছে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে সেই প্রভাব প্রায় দেখা যায়নি—লিটারপ্রতি দাম এখনো ১৫২–১৬২ টাকার মধ্যে ঘুরছে। সরকারের নির্ধারিত খুচরা দাম আগস্টে লিটারপ্রতি ১৫০ টাকা ঠিক করা হলেও বিশ্ববাজারে টানা দাম কমার পরও আর কোনো সমন্বয় হয়নি। ফলে পুরোনো মূল্যসীমাই খুচরা বিক্রেতাদের বাধ্যতামূলক মানদণ্ড হিসেবে থেকে গেছে।

৮ আগস্ট সরকারের সর্বশেষ মূল্য নির্ধারণের সময় অপরিশোধিত পাম অয়েলের (সিপিও) বুকিং মূল্য ছিল টনপ্রতি ১,০২৬–১,০৪৫ ডলার। এরপর পর্যায়ক্রমে দাম কমে নভেম্বর নাগাদ দাঁড়ায় ৯৫০–৯৮০ ডলারে। ২৮ নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবরে গড় বুকিং মূল্যের তুলনায় দাম ৭৫ ডলার কমে গেছে। ৮ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বরের মধ্যে কয়েক ধাপে কমে দাম ৯৫৩ ডলারের নিচে নেমে আসে—যা সাম্প্রতিক বছরের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন।

এই বিশাল আন্তর্জাতিক মূল্যপতন এবং সরকারের পুরোনো দাম ধরে রাখার ব্যবধানের কারণেই পাইকারিতে বড় পতন ঘটলেও তা খুচরা দামে প্রতিফলিত হয়নি।

এক মাস আগেও মণপ্রতি ৬,১০০ টাকায় বিক্রি হওয়া পাম অয়েল বর্তমানে ৫,৭৭০ টাকায় নেমে এসেছে—যা বছরের সবচেয়ে কম পর্যায়। কিন্তু সরকারি মূল্যসীমা পরিবর্তন না হওয়ায় খুচরা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ১৫০ টাকার নিচে আসতে পারছে না। টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণেও একই চিত্র—খুচরা বাজারে পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৫২–১৬২ টাকায়।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের মাসিক মূল্য পর্যালোচনা পদ্ধতি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গত তিন মাসে কোনো সংশোধন না হওয়ায় খুচরা বিক্রেতারা বাধ্য হচ্ছেন আগের ঘোষণাকৃত দাম মেনে চলতে—যখন বিশ্ববাজারে দাম ছিল উল্লেখযোগ্য বেশি।

শীত মৌসুমের প্রভাবও পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। শীত পড়লে পাম অয়েল জমে যাওয়ায় লেনদেন ধীর হয় এবং নগদ ক্রয়ে তেল কেনা তুলনামূলক ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে চীনসহ শীতপ্রধান দেশগুলোর চাহিদা হঠাৎ কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহচাপ বেড়ে দাম আরও নিচে নেমেছে। মালয়েশিয়ান পাম অয়েল বোর্ডের (এমপিওবি) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে সিপিও উৎপাদন ১১% বেড়ে হয়েছে ২০.৪৩ লাখ টন এবং মজুত বেড়েছে ১৬.৫৫%। উৎপাদন-মজুত—উভয় বৃদ্ধির ফলে বুকিং মূল্য ৪,৫০০ রিঙ্গিত থেকে নেমে এসেছে ৪,০০০ রিঙ্গিতে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ—দেশের সবচেয়ে বড় ভোজ্যতেল পাইকারি বাজার—সেখানে ব্যবসায়ীরা বলেন, এই সময়ে দেশে পাম অয়েলের চাহিদা কম থাকে। ফলে পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরায় স্থিতিশীল থাকে। আরেকটি কারণ হলো সরকার নির্ধারিত দামই খুচরা বিক্রেতাদের জন্য কার্যকর নীতিমালা।

একজন এসও (সাপ্লাই অর্ডার) ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন জানান, সাম্প্রতিক কমতির ধাক্কায় পাম অয়েলের বুকিং মূল্য কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছিল। যদিও এখন সামান্য বেড়েছে, বর্তমান মূল্য হারে আমদানি করলে খুচরা পর্যায়ে দাম আরও কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। তার মতে, সরকার এখনই দাম সমন্বয় করলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং রমজানের আগেই পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।

বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলার মতে, মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় সমন্বয় বিলম্বিত হয়। বিশ্ববাজারে দাম কমলে আমদানিকারকেরা কমাতে অনাগ্রহী থাকেন, অথচ বাড়লে দ্রুত চাপ তৈরি করেন। অন্যদিকে সরকারের সিদ্ধান্তও আসে দেরিতে—ফলে সরকারি মূল্যসীমা বাস্তবে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

তার ভাষায়, আমদানিকারকেরা ঢালা পাম অয়েল, সুপার পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম নিজেদের খরচ অনুযায়ী ঠিক করেন। বাজারে দুর্বল নজরদারি থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি দাম কাগজে-কলমে থেকে যায় এবং ভোক্তারা প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হন।

দেশের প্রধান ভোজ্যতেল বাজারে পাইকারি মূল্যপতন ও আন্তর্জাতিক বাজারের স্থায়ী নিম্নমুখী প্রবণতা সত্ত্বেও খুচরা দামে পরিবর্তন না হওয়া—মূল্য নির্ধারণের দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্বল বাজার তদারকির বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অকা/প্র/ই/সকাল/৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে

Leave A Reply

Exit mobile version