অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশের পুঁজি বাজারে অস্থিরতা কমছেই না বরং ক্রমাগত বাড়ছেই। বড় উত্থান প্রবণতায় পুঁজি বাজারে লেনদেন শুরু হয়। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই লেনদেন শেষ হয় নেতিবাচক প্রবণতায়। উত্থানের দিনগুলোতেও যে পরিমাণ কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ে তার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ পতনের শিকার হয়। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দিন দিন অস্থিরতা বাড়ছে। লেনদেনে টাকায় ও শেয়ারে বাড়লেও ডিএসইতে ৮৯.৪২ শতাংশ কোম্পানি দর হারিয়েছে। আর চট্টগ্রামে ৮১.১৯ শতাংশ কোম্পানির দরপতন হয়েছে। লেনদেন বাড়লেও ডিএসইর বাজার মূলধন থেকে পাঁচ হাজার ১০৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা চলে গেছে। এদিকে, ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার দর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে দুই স্টক মার্কেটকে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
রয়্যাল ক্যাপিটাল বাজার বিশ্লেষণে বলছে, আশঙ্কাকে বাস্তব রূপ দিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বরও সূচকের পতন হয়েছে। দিনের প্রথম ঘণ্টায় সূচক ৫৮৩৫ পয়েন্টে পৌঁছায়, তবে তা আগের দিনগুলোর মতোই বিক্রির চাপের সম্মুখীন হয়েছে। এর পেছনে নীতিগত সুদহারের বৃদ্ধি যত না প্রভাব ফেলেছে তার থেকে ২৭টি শেয়ার জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা বেশি ভূমিকা রেখেছে। সূচকের গতি প্রকৃতি বাজারের বেওয়ারিশ মনোভাবকে নির্দেশ করছে। ডিএসইএক্স ৪১ পয়েন্ট কমার বিপরীতে লেনদেন বেড়েছে ৫১ কোটি টাকা।
দিনের লেনদেনের তথ্য থেকে বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, লেনদেনের প্রথম ঘণ্টায় সূচকের বেশ চাঙ্গাভাব ছিল। এ সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ৬১ পয়েন্ট বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়। তারপর থেকেই দেখা যায় ধারাবাহিক পতন। বাজার আর সামনে এগোতে পারেনি। কেবল নিচেই নেমেছে। শেষ বেলায় সূচক বড় পতনের বৃত্তে পড়ে যায়। ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) আগের কার্য দিবসের চেয়ে সূচক ৪১.৪৫ পয়েন্ট কমে পাঁচ হাজার ৭৩৬.৫১ পয়েন্টে, ডিএস-৩০ মূল্যসূচক ১৪.৪০ পয়েন্ট কমে দুই হাজার ৯৫.০৫ পয়েন্টে নেমেছে। আর শরিয়াহ সূচক (ডিএসইএস) ৫.০৭ পয়েন্ট বেড়ে এক হাজার ২৯৩.২০ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর শেয়ার লেনদেন হওয়া কো¤পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ২৮টির, কমেছে ৩৫৫টির বা ৮৯.৪২ শতাংশের এবং অপরিবর্তিত ছিল ১৪টি কোম্পানির। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এদিন মোট ৩৯৭টি কো¤পানির ২৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার ৫৫৯টি শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড লেনদেন হয়েছে। যার বাজার মূল্য ছিল ৭৯৬ কোটি ৯৩ লাখ সাত হাজার ২২৫ টাকা। ২৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছিল ৭১৮ কোটি টাকার শেয়ার। ফলে টাকায় লেনদেন বেড়েছে ৭৮ কোটি টাকা এবং শেয়ার বেড়েছে চার কোটি।
আর ডিএসইর ব্লক মার্কেটে ২৫ সেপ্টেম্বর লেনদেনে অংশ নেয়া ৩৫টি কোম্পানির ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৫০৮টি শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড হাতবদল হয়েছে মোট ১০ কোটি ৯৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় বাজারমূল্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শেয়ার লেনদেন হওয়া পাঁচ কোম্পানি হলোÑ বিচ হ্যাচারি, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ইসলামী ব্যাংক এবং প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মোট শেয়ার লেনদেন হয়েছে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ টাকারও বেশি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বিচ হ্যাচারির শেয়ার। কোম্পানিটির দুই কোটি ২১ লাখ ১৪ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮৮ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ৮৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন করে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড। অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে- ইসলামী ব্যাংকের ৭৪ লাখ ৯ হাজার টাকার এবং প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ৭২ লাখ ৮৬ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
লেনদেনের ভিত্তিতে (টাকায়) শীর্ষে ১০ কো¤পানি: লেনদেনে শীর্ষে থাকা কোম্পানির মধ্যে রয়েছে, ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, জিপি, এসআইবিএল, সোনালি আঁশ, ইবনে সিনা ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা, বিএটিবিসি, এমজেএল বিডি ও রবি এক্সিয়াটা।
দরবৃদ্ধির শীর্ষে কো¤পানি : ডিএসইতে দরবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল, গ্রামীণ স্কিম-২ মি.ফা., ইসলামিক ফাইন্যান্স, আইএফআইএল ইসলামিক মি. ফা-১, শেফার্ড ইন্ডা:, তৌফিকা ফুড, প্রাইম ফাইন্যান্স প্রথম মি. ফা., ডেফোডিল কম্পিউটারস ও বিএসসি।
দর পতনের শীর্ষে কো¤পানি : দর পতনের শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলো হলো, ফু-ওয়াং ফুড, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, নাভানা ফার্মা, সিএনএ টেক্স, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স নিউ লাইন, মেট্রো স্পিনিং, কেডিএস এক্সেসোরিজ, ইয়াকিন পলিমার ও আমান ফিড।
আর চট্টগ্রাম স্টকে মূল দুই সূচক শত পয়েন্ট হারিয়েছে। এই স্টকেও ৮৯.১৩ শতাংশ কোম্পানি শেয়ারদর হারিয়েছে। সিএএসপিআই ১৭৪.৪৭ পয়েন্ট হারিয়ে ১৬ হাজার পয়েন্টকে ছুঁয়েছে। সিএসসিক্স ১০০.৪৬ পয়েন্ট হারিয়ে ৯ হাজার ৬৭০.৬২ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এছাড়া সিএসই-৩০ সূচক ২৪.৮৫ পয়েন্ট এবং সিএসই-৫০ সূচক ৩.৬৬ পয়েন্ট হারিয়েছে। ২৩৪টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিলেও দর পতনে ১৯০টি, দর বেড়েছে ৩০টির এবং দর অপরিবর্তিত ১৪টির। ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৩১২টি শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড হাতবদল হয়েছে মোট ১৮ কোটি ১৯ লাখ ৫৩ হাজার ১৬৩ টাকা বাজারমূল্যে।
ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর তদন্তের নির্দেশ : পুঁজি বাজারে ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণ তদন্ত করতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গতকাল বিএসইসির পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ডিএসইর প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর ও লেনদেন বেড়েছে, যা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। এ পরিস্থিতিতে ডিএসইকে ব্যাংকটির লেনদেন সম্পর্কে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়া হলো।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৯ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর ছিল ৩৯ টাকা ২০ পয়সা। ২৫ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে তা দাঁড়ায় ৭০ টাকা ৪০ পয়সায়। অর্থাৎ ১২ কার্যদিবসে ব্যাংকটির শেয়ারদর বেড়েছে ৩১ টাকা ২০ পয়সা বা প্রায় ৮০ শতাংশ।
জেড শ্রেণীতে ২৭ কোম্পানি : তালিকাভুক্ত ২৭ কোম্পানির ক্যাটাগরি পরিবর্তন করে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। আগামীকাল ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে কোম্পানিগুলোর লেনদেন ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে হবে। ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তাদের ওয়েবে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। কোম্পানিগুলো হলো : অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, ইন্দোবাংলা ফার্মা, বিচ হ্যাচারি, দেশ গার্মেন্টস, অ্যাডভেন্ট ফার্মা, খুলনা পাওয়ার, প্যাসিফিক ডেনিমস, ফরচুন সুজ, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ভিএফএস থ্রেড ডাইং, শেফার্ড, এসকে ট্রিমস, লুবরেফ বাংলাদেশ, লিবরা ইনফিউশন, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, ফনিক্স ফাইন্যান্স, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, ন্যাশনাল টিউবস, ন্যাশনাল ব্যাংক, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, জিএসপি ফাইন্যান্স, ফার কেমিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মা, বিডি থাই, বে লিজিং, এটলাস বাংলাদেশ এবং আনলিমা ইয়ার্ন।
কোম্পানিগুলোকে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগারি থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। জানা গেছে, সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করায় এসব কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এর আগে ২০ মে এক নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি জানায়, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি শেষ লভ্যাংশ ঘোষণার তারিখ থেকে বা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির তারিখ থেকে পরপর দুই বছরের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হলে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ডিএসইর নির্দেশনা মোতাবেক কোম্পানিগুলোকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করেছে।
লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ১.০৮ কোটি শেয়ার হস্তান্তরের ঘোষণা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের এক উদ্যোক্তা পরিচালক এক কোটি আট লাখ শেয়ার হস্তান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তাদের ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ করেছে। কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক মাহবুব উল আনাম এক কোটি আট লাখ শেয়ার হস্তান্তর করবেন। এই উদ্যোক্তা পরিচালক তার পুত্র আবরার আনাম চৌধুরীর কাছে এই পরিমাণ শেয়ার হস্তান্তর করবেন। এসব শেয়ার আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে উপহার হিসেবে হস্তান্তর সম্পন্ন করবেন।
অস্বাভাবিক দরে কারণ জানে না রহিম টেক্স: অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বাড়ার কারণ জানে না পুঁজি বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রহিম টেক্সটাইল মিলস পিএলসি বলে ডিএসই তথ্য প্রকাশ করেছে। কোম্পানিটির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে সম্প্রতি নোটিশ পাঠিয়েছে ডিএসই। এর জবাবে কোম্পানিটি জানায় কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ারদর বাড়ছে। উল্লেখ্য, ১০ সেপ্টেম্বর রহিম টেক্সটাইলের শেয়ার দাম ছিল ১২৫ টাকা ২০ পয়সায়, যা ২৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০ টাকা ৬০ পয়সায়। অর্থাৎ ৯ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ৩৫ টাকা ৪০ পয়সা। এই দর বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছে ডিএসই। ●
অকা/পুঁবা/ফর/সকাল/২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 year আগে