অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা। তবে এ সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে প্রস্তুতি নিতে হবে বলে মনে করেন তারা।
মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
সফরে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি ও কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বিনিয়োগ বাড়ানো, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ উভয় দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন দুই দেশের সরকারপ্রধান। ড. ইউনূসের এ সফরের সফলতা ও প্রাপ্তি নিয়ে কথা বলেন দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। সফর ঘিরে যে আশার সঞ্চার হয়েছে তা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের প্রতি জোর দেওয়ার কথা বলেন তারা।
পোশাক শিল্প আরও এগিয়ে যাওয়ার আশা
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এর সফলতার বিষয়েও আমরা অত্যন্ত আশাবাদী। চীনা সরকার যেভাবে ইতিবাচকভাবে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য এগিয়ে এসেছে, তা আমাদের জন্য খুবই ভালো।’ ‘চীন আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। আমরা তাদের থেকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা নেই। কাঁচামাল আমদানিরও সবচেয়ে বড় বাজার। চীন থেকে বিনিয়োগ সরে আসছে। আমরা বিনিয়োগপ্রত্যাশী। চীন সরকার তাদের ব্যবসায়ীদের উৎসাহী করবে এখানে বিনিয়োগ করতে। এটা আমাদের জন্য বড় অর্জন হিসেবে দেখছি।’
তিনি বলেন, ‘এ সম্পর্কের সূত্র ধরে চায়নার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের আরও উন্নতি ঘটবে, যেটা শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখবে। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে বিশেষ করে কৃত্রিম তন্তু ও টেকনোলজিনির্ভর খাতে ইনভেস্টমেন্ট আসবে এবং আমাদের সেক্টর সামনে আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা করছি।’
বিনিয়োগে উৎসাহী করা বড় সুযোগ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ-চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য এ সফরে অনেক বিষয় আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাজার সম্প্রসারণ, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ, নতুন ঋণ ও আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি প্রভৃতি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করার কথা বলেছেন। এটা আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ।’ ‘আমরা যত তাড়াতাড়ি তাদের ব্যবসার সুযোগ করে দিতে পারবো, তত তাড়াতাড়ি এখানে আসবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার বিভিন্ন খাত রয়েছে। শুধু একটি বিশেষ অঞ্চল নয়, তাদের বিভিন্ন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এটা হলে আমরা চায়নিজ বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হবো। পাশাপাশি আমাদের রিফর্ম ও ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে, যাতে চীনা বিনিয়োগ এখানে আসে এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারি, রফতানি আরও বড় করতে পারি।’
চীনা বিনিয়োগকারীদের সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবতে হবে
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘ড. ইউনূসের চীন সফর ও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক উৎসাহব্যঞ্জক। এত বড় একটা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সুপার শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের বৈঠক হওয়া দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ সফর সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’ চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা ভালো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ সফরের ফলে তা আরও গভীরতর হবে। সফরের সময় টেকনিক্যাল ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক একটি চুক্তি সই হয়েছে। আমি মনে করি এটাও একটা ওয়েলকাম স্টেপ। দুই দেশের মধ্যে ইকোনমিক সম্পর্ক আরও বাড়ানোর যে সুযোগ রয়েছে তা কাজে লাগানোর একটি উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে।’ ‘দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো চায়নিজ ইকোনমিক জোনের কাজের গতি ত্বরান্বিত করা। অন্যদিকে, কমপক্ষে ৩০টির মতো চীনা বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা আমাদের জন্য একটা বড় আশার আলো দেখাচ্ছে।’
বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ প্রকাশ করার মানে এই নয় যে তারা অবশ্যই আসবে। তাদের আসা নির্ভর করবে আমরা তাদের জন্য কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবো তার ওপর। এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ তাদের জন্য কতটা সহায়ক হবে। আমাদের উচিত হবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা ও তাদের সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা করার জন্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। তাহলে চীনের বিনিয়োগ এখানে আসবে।’
মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চীনে আমাদের যে চলমান ঋণ রয়েছে তার সুদের হার কমানোর বিষয়ে বিবেচনা করার কথা বলেছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই ভালো। এক্ষেত্রে এই বিবেচ্য বিষয়টি যাতে আমরা কাজে লাগাতে পারি সেজন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এটা অর্জন করতে হবে।’
চায়না আমাদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জানিয়ে বলেন, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সামনে আমাদের জিএসপি সুবিধা থাকবে না। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে শুধু এফটিএ করলেই হবে না, আমরা ইতোমধ্যে ডিউটি ফ্রি সুবিধা পাচ্ছি কিন্তু এর সুবিধা কাজে লাগাতে পারছি না। কাজে লাগানোর জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। তা না হলে আমরা লাভবান হতে পারব না।’
নীতি যেন পরিবর্তন না হয়
পরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আমি এ সফরকে পজিটিভলি দেখি।’ ‘চীন বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। আমাদের উচিত এই আগ্রহগুলো কাজে লাগিয়ে প্রকৃতভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গভীর করা। চীনের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে সরকারই আসুক তারা নীতির পরিবর্তন করবে না এবং সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে উভয় দেশের স্বার্থে।’
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশ-চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল এক হাজার ৮৫০ দশমিক ৪০ কোটি ডলারের। চীন থেকে এক হাজার ৭৮২ দশমিক ৬৬ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৬৭ দশমিক ৭৩ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭১৫ কোটি ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ ৩৪১ দশমিক ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। আর বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি ছিল প্রায় ১০ কোটি ডলার।
চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে তুলা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ২২৫ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি হয়েছে নিউক্লিয়ার রেক্টর ও বয়লার- যার মূল্য ছিল ২১৫ কোটি ডলার। ইলেক্ট্রনিক্স ও বৈদ্যুতিক যন্ত্র আমদানি হয়েছে ১৭২ কোটি ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ৮ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে এবং চীনে রফতানি করেছে ৪৬১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। গত অর্থ বছরে চীন থেকে মোট আমদানি মূল্য ছিল ১৬ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৭১৫ মিলিয়ন ডলার। ●
অকা/বাণিজ্য/ফর/রাত/২ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 9 months আগে
