অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, গম, সয়াবিন ও জ্বালানি আমদানি ক্রমেই বাড়াচ্ছে। এর ফলে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্য বদলাতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদি এ ছাড় কার্যকর হয়, তবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে এবং রপ্তানিতে নতুন সুযোগ উন্মুক্ত হবে।
বাণিজ্য আলোচনায় আশার বার্তা
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর)-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, যুক্তরাষ্ট্র আশ্বাস দিয়েছে—বাংলাদেশ যদি আরও বেশি মার্কিন কৃষিপণ্য ও জ্বালানি আমদানি করে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারে, তবে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক হ্রাস করা হতে পারে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসায় যুক্তরাষ্ট্র সন্তোষ প্রকাশ করেছে। চলতি মাসেই দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে বলেও তিনি ইঙ্গিত দেন।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি হয়েছিল, কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই এ আমদানি ২৭৬ মিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার কৌশল
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম প্রধান বাজার। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম, ভারতসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। এসব দেশও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কহার কমানোর বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ চাইছে অন্তত ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে শুল্ক নামানো হোক।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “আমরা তুলাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি বাড়াব। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত অনুযায়ী শ্রমিক অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেব। শুল্ক ১৫ শতাংশে নামলে আমাদের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বাড়বে।”
বিকেএমইএ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেমও জানান, বাংলাদেশের প্রত্যাশা হলো তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া। সেটি হলে উভয় দেশের জন্যই ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ তৈরি হবে।
বাড়ছে মার্কিন কৃষিপণ্য ও জ্বালানি আমদানি
বাংলাদেশের কাঁচামাল ও জ্বালানির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে দেশের মোট তুলা চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, বাকি ৯৮ শতাংশ আমদানি করতে হয়। এর বড় অংশ এখন আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী—
-
চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন ও সয়া মিল আমদানি ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে (২০২৪ সালে ছিল ৩৪৮.৯ মিলিয়ন ডলার)।
-
বেসরকারিখাত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইতিমধ্যেই ১০ লাখ টন সয়াবিন আমদানি করেছে। যদিও দাম তুলনামূলক বেশি, তবে মান ও তেল উৎপাদনের অনুপাতে তা লাভজনক।
-
জুলাই মাসে সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬০০ কোটি টাকার এলএনজি আমদানির অনুমোদন দিয়েছে এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় দেড় লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছে।
-
সম্প্রতি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ৯৩৫ কোটি টাকায় দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কিনেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানি থেকে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, রাশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের গমে প্রোটিনের পরিমাণ ১০-১৫ শতাংশ বেশি। তাই দাম কিছুটা বেশি হলেও মানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চুক্তি সম্ভাবনা
ইউএসটিআরের সহকারী প্রতিনিধি ব্রেন্ডেন লিঞ্চের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে। তারা ইতিমধ্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আজ সোমবার তারা বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে বসবেন এবং আগামীকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই একটি প্রাথমিক বাণিজ্য চুক্তির খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আলোচনায় দুই পক্ষ একমত হলে সংশোধন এনে তা চূড়ান্ত করা হবে।
বাংলাদেশের ওপর আরোপিত পাল্টা শুল্ক যদি ১৫ শতাংশে নামানো যায়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা আরও বাড়বে। একই সঙ্গে মার্কিন কৃষিপণ্য, জ্বালানি ও প্রযুক্তি আমদানি বাড়ানো হলে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতিও কমে আসবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ উদ্যোগ সফল হলে এটি হবে বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ, যা রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 days আগে