আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পের কাঁচামালের দাম যৌক্তিক সীমায় নেমে এলেও এর সুবিধা নিতে পারেনি দেশের শিল্প-কারখানাগুলো। জ্বালানি সংকট ও আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্প তার সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। ডলারের উচ্চমূল্যে বেড়ে গেছে উৎপাদন ব্যয়। এমন নানা সংকটের মুখে শিল্পের প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমে এসেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) শিল্পের প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে কম। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমেছে। যা দুই বছর আগেও ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়েও এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। সম্প্রতি প্রান্তিক জিডিপির এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে সেবা খাতে। এরপরই শিল্প খাতের অবস্থান। গত কয়েকটি অর্থবছরে অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ৩৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। জিডিপিতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি অবদান রাখা খাতটির প্রবৃদ্ধি এখন মারাত্মক হারে হ্রাস পাওয়ায় কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল কারণটা ছিল আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড় ঘাটতি ইত্যাদি কারণ।
তিনি বলেন, সবকিছুর ফলে দেশের উৎপাদন খাত ব্যাহত হয়েছে। শিল্প খাতে বড় দুটির একটি উৎপাদন খাত। এটি ব্যাহত হয়েছে আমদানি সীমাবদ্ধতার কারণে। বিদ্যুতের সংকট ছিল, গ্যাসের সংকট ছিল এগুলো এখনো আছে। একই সঙ্গে রফতানিও কম হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের শিল্প খাতের প্রভাব পড়েছে। শিল্প খাতের আরেকটি বড় অংশ জ্বালানি খাত। এ খাতও ব্যাহত হয়েছে কারণ আমরা গ্যাস আমদানি করতে পারিনি। যার কারণে বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদনের খাতের ধীরগতির কারণেই দেশের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
কলকারখানার মূল জ্বালানি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ, যেটি আগের প্রান্তিকেও ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
বিভিন্ন সংকটের মধ্যেও এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর ২০২০-২১-এ ছিল ৩৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে ইতিপূর্বেই পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)।
চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও খানিকটা কমেছে। তবে শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে বড় পতনের কারণে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) এক ধাক্কায় প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে দিয়েছে। বিবিএসের তথ্য বলছে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে স্থির মূল্যে চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
অন্য বছরের সঙ্গে এবারের জিডিপির এত পার্থক্য থাকার ব্যাখ্যা দিয়েছে বিবিএস। সংস্থাটি বলছে, আইএমএফের কোয়ার্টারলি ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস ম্যানুয়াল অনুযায়ী, কোনো প্রান্তিকের জিডিপির প্রথম প্রাক্কলনের সময় হালনাগাদ সব তথ্য-উপাত্ত বিদ্যমান থাকে না বিধায় পরবর্তী সময়ে তা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। ফলে পূর্ববর্তী প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি মূল্যে জিডিপির আকার ১৩ লাখ ৯ হাজার ৮৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১ লাখ ২৬ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।
শিল্পের পাশাপাশি কমেছে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে স্থির মূল্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এ প্রান্তিকে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
সর্বশেষ প্রান্তিকে বাংলাদেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে। তবে তা আশানুরূপ নয়। দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপির তথ্য বলছে, কৃষিতে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে স্থির মূল্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা আগের বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তখনই অর্থনীতিবিদরা একে উচ্চাভিলাষী বলেছিলেন। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার একটি আলোচনা চলছে।
শিল্প খাতের এমন দুরবস্থার মধ্যে দেশের ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে ঋণের সুদ হার। ফলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে গেছে। ২০২৩ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশে, যেখানে ২০২২ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 years আগে

