অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
আমদানি পণ্যের উপর উচ্চ হারে কাস্টমস ডিউটি আরোপের মাধ্যমে দেশের স্থানীয় শিল্পকে বছর পর বছর ধরে দেওয়া শুল্ক সুরক্ষা সুবিধার শিগগিরই অবসান ঘটবে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় স্থানীয় শিল্পগুলোকে আরও দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে প্রস্তুত করা ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি ২০২৩-এর খসড়া অনুসারে, কিছু নির্দিষ্ট পণ্যকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই সুরক্ষা দেওয়া হবে।
দেশের প্রথম ট্যারিফ পলিসির অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা, রফতানি বাড়ানো এবং একইসঙ্গে স্থানীয় ও আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে মূল্যবৈষম্য হ্রাসের মাধ্যমে ভোক্তাদের সুবিধা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে গড় ট্যারিফ ১৪ শতাংশ, যেখানে উন্নত দেশগুলোর গড় ট্যারিফ ৮.৫ শতাংশ। বিশ্ব বাণিজ্যে সংহতি আনার সুবিধার্থে দেশগুলো ট্যারিফ কমাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পসহ অনেকগুলো স্থানীয় শিল্পের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খসড়া ট্যারিফ নীতিমালা রফতানি খাতের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক বন্ড সুবিধা বাতিল করতে চায়। স্থানীয় অনেক শিল্পের অভিযোগ, এই সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে, যার ফল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা।
খসড়া নীতিমালায় একই পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন আমদানিকারকের জন্য আলাদা ট্যারিফ ব্যবস্থা বাতিল করা, জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ না করা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ন্যূনতম ভ্যালু নির্ধারণ প্রথা বাতিল করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই খসড়া নীতিমালার প্রস্তুতকারক বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর উপস্থিতিতে আগামী সপ্তাহে সভা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে তা চূড়ান্ত করা হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অনুমোদন পেলে আগামী বছরই জাতীয় শুল্ক নীতিমালা বাস্তবায়িত হবে।
সুরক্ষা পদক্ষেপ আরও কতদিন অব্যাহত রাখতে হবে, তা জানাতে বিদ্যমান শিল্প ছাড়াও নতুন পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প ও এখনও 'ইনফ্যান্ট' (নতুন) শিল্পগুলোকে বলেছে কমিশন।
ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসির অন্যান্য বিষয় ও লক্ষ্য হলো: ভিশন ২০৪১ ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জন, এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, শুল্ক ব্যবস্থার যৌক্তিকীকরণ, বিনিয়োগে উৎসাহ দান, বাহ্যিক অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানো।
এ বিষয়ে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও ট্যারিফ পলিসিবিষয়ক কমিটির উপদেষ্টা ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, 'নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ট্যারিফ প্রটেকশন দেওয়া হলে স্থানীয় শিল্পগুলো নিজদের প্রতিযোগী-সক্ষম করে গড়ে তুলতে মনোযোগী হবে। অন্যথায় তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে না।'
তিনি বলেন, এই ট্যারিফ নীতিমালা চূড়ান্ত হলে তা দেশের শিল্পকে টেকসই করতে সহায়তা করার পাশাপাশি ভোক্তার উপরও অত্যধিক করের ভার কমাতে সহায়তা করবে। অধিকাংশ ব্যবসায়ী নেতারা নতুন নীতিমালার উদ্যোগের বিষয়ে একমত
ব্যবসায়ী নেতারা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তারা এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন, যেসবের ওপর মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ বলেন, আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি ট্যারিফের আরোপের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুরক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব যৌক্তিক ছিল।
'ইনফ্যান্ট শিল্পের ক্ষেত্রে এই প্রটেকশন ৮ থেকে ১০ বছর হতে পারে,' বলেন তিনি। 'তবে কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে সমজাতীয় আমদানি পণ্যে হাইয়েস্ট ট্যারিফের মাধ্যমে প্রটেকশন নেয় এবং ওই সুবিধা হয়তো ওই কোম্পানি ছাড়া অন্যরা নিতে পারে না।'
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং দেশের শীর্ষ মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক রানার অটোমোবাইলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান বলেন, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুরক্ষা চাওয়া উচিত নয়।
'তবে সুরক্ষা তুলে নেওয়ার আগে সুরক্ষার লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়েছে কি না, তা যাচাই করে দেখতে হবে। লক্ষ্য অর্জিত না হলে, তার কারণগুলো খতিয়ে দেখতে হবে।'
এর আগে সুরক্ষা তুলে নিলে স্থানীয় শিল্পগুলো গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
স্থানীয় ব্যবসার বিকাশের সুযোগ করে দিতে আমদানির ওপর বাধা সৃষ্টি করে সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোম্পানি যদি স্থানীয়ভাবে কোনো পণ্য উৎপাদন করে, তাহলে ওই শিল্পকে রক্ষার জন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক-কর আরোপ করা হয়—যা স্থানীয় ওই শিল্পের জন্য সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্প ও শিল্প খাত বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় শিল্প প্রতিরক্ষণের নামে এ সুবিধা পেয়ে আসছে।
যেমন, বাংলাদেশ সুপার প্লাস্টিক পাইপ আমদানি করে, যার ওপর সব মিলিয়ে শুল্ক ১০৪ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে যদি একটি পাইপের দাম ১০০ টাকা হয়, তাহলে কেবল শুল্কের কারণে বাংলাদেশের ভোক্তাকে ওই আমদানিকৃত পাইপে বাড়তি ১০৪ টাকা ব্যয় করতে হবে।
আবার কোনো কোনো ফুটওয়্যার আমদানির ওপর শুল্কহার ১৭০ শতাংশ। এর ফলে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে ২৩৭ ধরনের খাদ্যপণ্যও এই হারে শুল্ক সুরক্ষা পায়।
বাংলাদেশের কত ধরনের শিল্প কী হারে কিংবা কত বছর ধরে সুরক্ষা পাচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ স্থানীয় ব্র্যান্ড অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, 'এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। সুরক্ষার উঁচু প্রাচীর সরিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। ফিনিশড জুতা আমদানি করতে হলে ১৭০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়, যা সেকেলে। এটা অবশ্যই কমানো দরকার।'
তবে শুল্ক সুরক্ষা পর্যায়ক্রমে বন্ধ হওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি। এছাড়া কৃষি ও পোল্ট্রির মতো কিছু শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া উচিত বলেও তিনি মত দেন।
#
অকা/প্র/ দুপুর, ২৭ নভেম্বর, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 years আগে

