অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
সাম্প্রতিক টানা বৃষ্টিপাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সবজিখেত প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় এর দাম দ্রুত বেড়ে গেছে। সবজির দাম বেশি হওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ভোক্তারা বিকল্প হিসেবে বেশি পরিমাণে ডিম কিনছেন। এর ফলে হঠাৎ করেই ডিমের চাহিদা বেড়েছে, আর চাহিদার চাপেই বাজারে ডিমের দামও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। দীর্ঘদিন লোকসানের মধ্যে থাকা খামারিরা এ অবস্থাকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক হিসেবে দেখছেন।
টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের খামারি জাহিদুল ইসলাম, যিনি গত ১৫ বছর ধরে লেয়ার মুরগির খামার পরিচালনা করছেন, জানান—“ছয় মাস ধরে ডিমের দাম কম থাকার পর এবার আবার চাহিদা বেড়েছে।” ১২ আগস্ট তিনি বলেন, বর্তমানে খামারিরা প্রতি ডিম বিক্রি করছেন ৯ টাকা ৫০ পয়সায়। অথচ প্রতি ডজন ডিম উৎপাদনে তাদের খরচ পড়ছে গড়ে ১০ টাকা ২৫ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ, এখনো প্রতি ডিমে কিছুটা লোকসান রয়েছে। তার খামারে ৮,৫০০ লেয়ার মুরগি রয়েছে। গত কয়েক মাসে যখন প্রতিটি ডিম মাত্র ৭ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে, তখন তিনি ডিমপ্রতি গড়ে ২ থেকে ২.৫ টাকা লোকসান গুনেছেন। টানা ক্ষতির কারণে খামার চালিয়ে রাখতে তাকে ব্যাংক থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। তার মতে, মাংস, মাছ ও সবজির দাম বৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন বেশি ডিম কিনছেন, ফলে বাজারে দাম কিছুটা বেড়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন আনুমানিক ৪ কোটি ৫০ লাখ ডিম উৎপাদিত হয়, অথচ দৈনিক চাহিদা প্রায় ৫ কোটি। তবে প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ গ্রামীণ পরিবারগুলোতে বিপুল সংখ্যক গৃহপালিত মুরগি প্রতিদিন ডিম দেয়, যা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। তবে অভিজ্ঞরা বলছেন, সবজির দাম বাড়লে নিয়মিতভাবেই ডিমের চাহিদা এবং দাম বাড়ে।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার শৈলবাইত এলাকার খামারি মজনু মিয়া, যার খামারে প্রায় ৪ হাজার মুরগি রয়েছে, বলেন—গত কয়েক মাসে বিপুল সংখ্যক খামারি লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে সামগ্রিক উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। তার মতে, বর্তমানে বাজারে প্রান্তিক খামারিদের টিকে থাকতে হলে প্রতিটি ডিমের ফার্মগেট মূল্য কমপক্ষে ১১ টাকা হওয়া জরুরি।
মধুপুরেরই ইদিলপুর গ্রামের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন জানান, তাদের পারিবারিক খামারটি এখন লোকসানি প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, “দাম কিছুটা বেড়েছে, যা খামারিদের জন্য ভালো হলেও এই ধারা বেশি দিন টিকে থাকবে বলে মনে হয় না। সর্বোচ্চ ২-৩ মাসের মধ্যেই আবার দাম কমে যেতে পারে।”
এদিকে সখিপুরের স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও ডিম ব্যবসায়ী মাওলানা জাহিদুল ইসলাম প্রতিদিন স্থানীয় খামারগুলো থেকে প্রায় ৪০ হাজার ডিম সংগ্রহ করে গাজীপুর ও ঢাকার বাজারে সরবরাহ করেন। তিনি জানান, সম্প্রতি ডিমের চাহিদা বেড়েছে। তবে দাম বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সিন্ডিকেটের প্রভাব নেই বলেই তিনি দাবি করেন। তার কথায়, “আমি প্রতিটি ডিম বিক্রিতে মাত্র ১০ পয়সা পাই। বাজারে দামের ওঠানামায় আমার কোনো প্রভাব নেই, স্থানীয়ভাবে খুচরা বিক্রি করে কিছুটা লাভ করা সম্ভব হয়।”
ঘাটাইলের গনোগ্রামের ব্যবসায়ী রহিম উদ্দিনও সিন্ডিকেটের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, গত শীত মৌসুমে সবজির প্রাচুর্যের কারণে ডিমের চাহিদা কমে গিয়েছিল এবং দামও পড়ে যায়। “তখন প্রতিটি ডিম ৭ টাকায় কিনেও বেশি দামে বিক্রি করতে পারিনি। বাজারে যখন সরবরাহ বেশি হয় এবং চাহিদা কমে যায়, তখন দামের পতন স্বাভাবিক।”
বাংলাদেশের ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ডলারের উচ্চমূল্য, খাদ্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং অন্যান্য উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ডিমের বাজারে স্থিতিশীলতা ছিল না। সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি করতে গিয়ে খামারিদের লোকসান গুনতে হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, “ডিমের দাম কমে গেলে খামারিদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে কেউ কথা বলে না।” এ অবস্থায় খামারিদের ব্যবসা টেকসই করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তারা দাবি জানিয়েছে—ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য নির্ধারণের সময় উৎপাদন খরচের সঙ্গে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ মুনাফা যোগ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিকে খামারিরা লোকসান কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে ভোক্তাদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সবজির দাম আরও কিছুদিন বেশি থাকলে ডিমের দামও স্থিতিশীলভাবে উঁচুতে থাকতে পারে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে খামারিদের আশঙ্কা, সাময়িক এই স্বস্তি খুব বেশি দিন নাও টিকতে পারে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 18 hours আগে