অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
স্মরণকালের লাগামহীন দরপতনে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন পুঁজি বাজারের বিনিয়োগকারীরা। হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। বড় ধরনের এই পতনে এক দিনেই পুঁজি বাজার থেকে ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি উধাও হয়ে গেছে। শুধু ২ অক্টোবর ডিএসইতে ১৩২.২৯ পয়েন্ট এবং সিএসইতে ৩০৬.১৭ পয়েন্ট হারিয়েছে। আর বর্তমান কমিশনের সময়ে ডিএসই প্রধান সূচক কমেছে ৪৫০ পয়েন্ট। এর মধ্যে গত তিন দিনে সূচক কমেছে ২১৫ পয়েন্ট। ৩০ সেপ্টেম্বর কমেছে ৩৪ পয়েন্ট, ১ অক্টোবর কমেছে ৩৮ পয়েন্ট। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনেক দিন পতনের সেঞ্চুরি হয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট ডিএসইর সূচকের পতন হয়েছিল ১০৪ পয়েন্ট। ওই পতন ছিল গত দুই বছরের মধ্যে অন্যতম বড় দরপতন। ২ অক্টোবর সেই পতনকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্লেষক রয়্যাল ক্যাপিটাল বলছে, আস্থার সঙ্কট প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। শেয়ারের ক্যাটাগরি পরিবর্তনসহ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কিছু পদক্ষেপ সাময়িকভাবে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।
পুঁজি বাজারের বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি অন্ধ মানুষের মতো কেবল শাস্তিই আরোপ করে যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্রোকারেজ হাউজ থেকে অস্বাভাবিক সেল প্রেসার দিয়ে বাজারকে অব্যাহতভাবে নিচে নামাচ্ছে। সেই বিষয়ে কার্যকরভাবে মনিটর করা হচ্ছে না। যার ফলে বাজারে অস্বাভাবিক সেল প্রেসারও থামছে না। তারা বলেন, বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীর সাপোর্ট তৈরি না হওয়ায় এবং শাস্তির আওতায় থাকা সালমান রহমান ও শিবলী রুবাইয়াতের উত্তরসূরীরা পুঁজি বাজারে অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে তুলছেন। যে কারণে বাজার অব্যাহতভাবে নিচের দিকেই নামছে। প্রয়োজনীয় সাপোর্ট না থাকায় বাজারের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।
পতনের বাজার সম্পর্কে রয়্যাল ক্যাপিটাল বলছে, ডিএসইর বাজার মূলধন ১.১৯ শতাংশ বেরিয়ে গেছে। ঢাকার শেয়ার বাজারের প্রধান সূচক (ডিএসইএক্স) নিম্নমুখী ছিল এবং মূলধন গত দিনের তুলনায় ১.১৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যেখানে, ভলিউম ১৫ শতাংশ এবং টার্নওভার ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ১৯টি সেক্টরের মধ্যে সবগুলো সেক্টরের বাজার মূলধন হ্রাস পেয়েছে। শুরু থেকেই বাজার নেতিবাচক ছিল, যা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়েছে।
লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাজারের পরিস্থিতি শঙ্কাজনক। ডিএসইর লেনদেন শুরুর প্রথম ঘণ্টায় প্রধান সূচক বা ‘ডিএসইএক্স’ ১১৪ দশমিক ২৯ পয়েন্ট কমে হারিয়ে যায়। তখন সূচক ৫ হাজার ৪৭১ পয়েন্টে ছিল। একই সময়ে শরিয়াহ সূচক বা ‘ডিএসইএস’ ২৯ দশমিক ১৪ পয়েন্ট কমে এক হাজার ২২৩ পয়েন্টে আর ‘ডিএসই-৩০’ সূচক ৪২ দশমিক ২৮ পয়েন্ট কমে এক হাজার ৯৯৭ পয়েন্টে নেমে আসে। ওই সময়ে ডিএসইতে মোট ১৩৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ২৯টির, কমেছে ৩০৭টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪০টি কোম্পানির শেয়ারদর।
দিন শেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) আগের দিনের চেয়ে সূচক ১৩২.২৯ পয়েন্ট হারিয়ে এখন পাঁচ হাজার ৪৫৩.৯৯ পয়েন্টে, ডিএসই-৩০ সূচক ৫১.৩৩ পয়েন্ট হারিয়ে এক হাজার ৯৮৮.০২ পয়েন্টে এবং ডিএসইএস শরিয়াহ সূচক (ডিএসইএস) ৩২.৫২ পয়েন্ট হারিয়ে এক হাজার ২১৯.৭১ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মোট ৩৯৮টি কো¤পানির ১৬ কোটি ৬৮ লক্ষ ৭৬ হাজার ৪০৪টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড লেনদেন হয়েছে। যার ২ অক্টোবরের বাজার মূল্য ৪৪০ কোটি ৮৩ লাখ ১২ হাজার ২৪ টাকা। তবে এই লেনদেন আগের দিনের তুলনায় ৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বেশি। লেনদেনকৃত কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ২৯টির, কমেছে ৩৪৭টির বা ৮৭.১৮ শতাংশের এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২২টি কোম্পানির শেয়ার। বড় ধরনের পতনের ফলে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে আট হাজার ৭৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এখন বাজার মূলধনের আকার ছয় লাখ ৭২ হাজার ৪৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
এ দিকে ডিএসইর ব্লক মার্কেটে ১৮টি কোম্পানি ২ অক্টোবর লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব কোম্পানির ৬৯ লাখ ১৯ হাজার ৫২২টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড হাতবদল হয়েছে মোট ১৪ কোটি ১০ লাখ ৪৬ হাজার টাকায়। তবে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া পাঁচ কোম্পানি হলো, ইফাদ অটোস, বিডি ফাইন্যান্স, এডিএন টেলিকম, ন্যাশনাল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মোট শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকারও বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ইফাদ অটোসের। কোম্পানিটির ৩ কোটি ৮২ লাখ ৫ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। বিডি ফাইন্যান্সের ৩ কোটি ৮১ লাখ ৩২ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। আর ২ কোটি ৫৯ লাখ ৮১ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন করেছে এডিএন টেলিকম। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেÑ ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকার এবং ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসির ৪৫ লাখ ১১ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
লেনদেন, দর বৃদ্ধি ও দর পতনে শীর্ষ কোম্পানি : ডিএসইতে লেনদেনের ভিত্তিতে (টাকায়) শীর্ষে ১০ কো¤পানি হলো- জিপি, লিন্ডে বিডি, ব্র্যাক ব্যাংক, সোনালী আঁশ, ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এমজেএল বিডি, এডিএন টেলিকম ও ইবনে সিনা ফার্মা। আর দর বৃদ্ধির শীর্ষে ১০টি কো¤পানি হলো- দেশ গার্মেন্ট, ফেডারেল ইন্স্যু:, আফতাব অটোমোবাইলস, এসআইবিএল, মেঘনা সিমেন্ট, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এডিএন টেলিকম, আমান কটন, জিআইবি ও ডিবিএইচ ১ম মি. ফা। এ ছাড়া দর পতনে শীর্ষে ১০ কোম্পানি হলো- ফু-ওয়াং ফুড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, গ্লোবাই ইন্স্যু:, অরিয়ন ফার্মা, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, বিএসসি, এশিয়া প্যাসেফিক ইন্স্যু:, ডমিনেজ স্টিল, জিএসপি ফাইন্যান্স ও শাইনপুকুর সিরামিকস।
ক্রেতা শূন্যের সীমান্তে দুই ডজন কোম্পানি : আর বড় পতনেও পুঁজিবাজারে মাত্র ৭টি কোম্পানির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা ছিল। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনার জন্য আগ্রহ ছিল না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ৭ কোম্পানির শেয়ার ক্রেতা শূন্য হলেও প্রায় ২ ডজন কোম্পানি ছিল ক্রেতাশূন্যের কিনারে। কোম্পানিগুলো হলো : ফু-ওয়াং ফুডস, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, ওরিয়ন ফার্মা, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, জিএসপি ফাইন্যান্স এবং ন্যাশনাল টি।
প্রাইম ব্যাংক উদ্যোক্তার ৭৫ লাখ শেয়ার হস্তান্তর : তালিকাভুক্ত প্রাইম ব্যাংকের এক উদ্যোক্তা পরিচালকের পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ৭৫ লাখ শেয়ার হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তাদের ওয়েবে প্রকাশ করেছে। কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক সালমা হক ৭৫ লাখ শেয়ার উপহার হিসেবে তার মেয়ে সারা হকের কাছে হস্তান্তর সম্পন্ন করেছেন। এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর এই শেয়ার হস্তান্তরের ঘোষণা দেয় এই উদ্যোক্তা পরিচালক।
চট্টগ্রামে তিন সূচকের পতনে ওভার সেঞ্চুরি : অন্য দিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচকসহ তিনটি সূচক পতনের সেঞ্চুরিকে অতিক্রম করেছে। সিএএসপিআই কমেছে ৩০৬.১৭ পয়েন্ট। আর সিএসসিএক্স ১৮৭.২৩ পয়েন্ট, সিএসই-৩০ সূচক ২৫৪.৩৯ পয়েন্ট, সিএসই-৫০ সূচক ২৩.৮৭ পয়েন্ট এবং সিএসআই ২১.২০ পয়েন্ট হারিয়েছে। লেনদেনে অংশ নেয়া ২১৬টি কোম্পানির মধ্যে ২৪টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৭৭টির বা ৮১.৯৪ শতাংশের এবং ১৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। ছাব্বিশ লাখ ৭ হাজার ৩৩৩টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড লেনদেন হয়েছে ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার ৫১৪ টাকা বাজারমূল্যে। মঙ্গরবার লেনদেন হয় ৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ফলে সামান্য কিছু বেড়েছে। বাজার মূলধন সাত হাজার ২০৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা কমে এখন সাত লাখ ৯ হাজার ১৩৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় নেমেছে।
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের সংশ্লিষ্টরা এবং বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজি বাজারে এখন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকদের অভাব। যারা আছে, তারা সবাই সালমান রহমান ও শিবলী রুবাইয়াতের গ্রুপের। এছাড়া, বিএসইসি ও ডিএসইতে যারা বসে আছেন, তারা কেউই বর্তমান কমিশনের পক্ষের লোকজন নয়। যে কারণে শেয়ার বাজার অব্যাহতভাবে নামছেই। তৈরি হচ্ছে নাজুক এক অবস্থার। ●
অকা/পুঁবা/ফর/সকাল/৩ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 year আগে