অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে মূলধন ও সুদ বাবদ মোট ৪.০৮৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। দেশের ইতিহাসে এটি এক অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ রেকর্ড, যা আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪ এর ৩.৩৭২ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় প্রায় ২১.২ শতাংশ বেশি।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই অর্থবছরে মূলধন বা আসল ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২.৫৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ২.০২ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২৮.৮ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৪৯১ বিলিয়ন ডলারে, যা গত অর্থবছরের ১.৩৪৯ বিলিয়নের তুলনায় ১০.৫ শতাংশ বেশি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত এক দশকে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন বড় প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাজেট সহায়তা এবং কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণের যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তারই ফল এখন দেখা যাচ্ছে। এসব ঋণের অধিকাংশের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় এখন নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে, যার কারণে ঋণ পরিশোধের চাপ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
তবে ঋণ পরিশোধ বৃদ্ধির বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নতুন বৈদেশিক ঋণ চুক্তি ও ঋণ বিতরণের পরিমাণে হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে। ইআরডির তথ্যমতে, এ সময় বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে মোট ৮.৩২৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪ এর ১০.৭৩৯ বিলিয়নের তুলনায় প্রায় ২২.৫ শতাংশ কম। একই সঙ্গে ঋণ বিতরণের পরিমাণও হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৫৬৮ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে আগের অর্থবছরে এই অঙ্ক ছিল ১০.২৮৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশে বৈদেশিক তহবিলের আগমন কিছুটা কমেছে, যা ভবিষ্যতে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলতে পারে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি প্রদানকারী দাতাদের মধ্যে শীর্ষে ছিল বিশ্বব্যাংক, যারা মোট ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার ছিল বাজেট সহায়তা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), যাদের প্রতিশ্রুতি ছিল ২ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা। জাপান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১.৮৯ বিলিয়ন ডলার এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৫৬১ মিলিয়ন ডলার।
ঋণ বিতরণে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল এডিবি, যারা এই অর্থবছরে ২.৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। এরপর বিশ্বব্যাংক বিতরণ করেছে ২.০১২ বিলিয়ন ডলার, জাপান ১.৫৮ বিলিয়ন ডলার, রাশিয়া ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার, এআইআইবি ৫২৭ মিলিয়ন ডলার, চীন ৪১৫ মিলিয়ন ডলার এবং ভারত ১৮৫ মিলিয়ন ডলার।
এই ঋণ পরিশোধের ঊর্ধ্বগতি একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতিফলন, অন্যদিকে এটি বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বাড়তি চাপও তৈরি করছে। কারণ, ঋণ পরিশোধে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হওয়ায় রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে যখন রফতানি ও প্রবাসী আয় প্রত্যাশার তুলনায় কম হচ্ছে, তখন এত পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে আরও সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঋণ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ, উচ্চ সুদের ঋণের পরিবর্তে স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের দিকে ঝোঁক, এবং প্রকল্পগুলোর ফলাফল নিরীক্ষা করে তবেই ঋণ নেওয়া দরকার। তা না হলে ভবিষ্যতে ঋণ ব্যবস্থাপনা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/২৯ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে

