অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বৈধ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার সমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে নতুন করে বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
এর মধ্যে নগদ পুঁজি হিসাবে দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, আর উদ্যোক্তাদের বিদেশি সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্জিত মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ করা হয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। একই সময়ে কোনো কোম্পানি অন্য কোম্পানির কাছ থেকে নতুন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেনি; বরং পূর্ববর্তী ঋণের ১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ১৮টির বেশি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে।
স্থিতি ও প্রবৃদ্ধির হার
২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৩৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের তুলনায় ১ কোটি ৪১ লাখ ডলার বা ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ বেশি। এর আগের বছর (২০২২–২৩ অর্থবছরে) স্থিতি কমেছিল ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগে পুনরুদ্ধার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব বিনিয়োগই বৈধভাবে নিবন্ধিত পুঁজি স্থানান্তর। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, অবৈধ অর্থপাচারের মাধ্যমে আরও বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি পুঁজি বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছে, যার আনুষ্ঠানিক হিসাব এই প্রতিবেদনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়।
বিনিয়োগ প্রবণতা ও কাঠামো
গত অর্থবছরে মোট ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের মধ্যে নগদ পুঁজি ছিল ১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার, এবং পূর্ববর্তী ঋণ পরিশোধ ১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। এর ফলে নিট পুঁজি স্থানান্তর কমেছে ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ, তবে মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ বেড়েছে ১৬৭ দশমিক ৪০ শতাংশ—যা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে অর্জিত লাভ পুনঃবিনিয়োগের ইতিবাচক সংকেত।
২০২২–২৩ অর্থবছরে নগদ পুঁজি স্থানান্তর ছিল ১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ ১ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং ঋণ পরিশোধ করা হয়েছিল ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। সে সময় তুলনামূলকভাবে বেশি ঋণ পরিশোধ করায় নিট বিনিয়োগে সংকোচন ঘটে।
দেশভিত্তিক বিনিয়োগ চিত্র
বিদেশে নেওয়া পুঁজির মধ্যে সর্বাধিক বিনিয়োগ করা হয়েছে ভারতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, যা মোট নতুন বিনিয়োগের প্রায় ৭০ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, তৃতীয় স্থানে সিঙ্গাপুরে ২১ লাখ ডলার, কেনিয়ায় ১৪ লাখ ডলার এবং আয়ারল্যান্ডে ১৫ লাখ ডলার।
অন্যদিকে, বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি—৮৩ লাখ ডলার—এসেছে ভারত থেকে। এটি নির্দেশ করে যে কিছু বিনিয়োগ ইতিমধ্যেই আয় ও প্রত্যাবর্তনের ধাপে প্রবেশ করেছে।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
সবচেয়ে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ফাইন্যান্স খাতে, যেখানে মোট ৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার মুনাফা ফেরত এসেছে। নিট পুঁজি নেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৯৭ লাখ ডলার।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে, যেখানে ১ কোটি ২ লাখ ডলার নেওয়া হয় এবং ফেরত আসে ৬৫ লাখ ডলার। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাত, যেখানে ২৯ লাখ ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ১৯ লাখ ডলার মুনাফা দেশে ফেরত এসেছে।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ অবস্থান
দেশ থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পুঁজি রয়েছে যুক্তরাজ্যে ১০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, দ্বিতীয় স্থানে ভারতে ১০ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, এবং তৃতীয় হংকংয়ে ৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫ কোটি ৮৫ লাখ, মালয়েশিয়ায় ১ কোটি ১৫ লাখ, কেনিয়ায় ৭৬ লাখ, সিঙ্গাপুরে ৬৪ লাখ, ওমানে ৩৯ লাখ, আয়ারল্যান্ডে ৩৮ লাখ, ইথিওপিয়ায় ১৯ লাখ, মালদ্বীপে ১২ লাখ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮ লাখ এবং গ্রিসে ৩ লাখ ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে নেওয়া ৫২ লাখ ডলারের বিপরীতে ২ কোটি ৯৮ লাখ ডলার মুনাফা দেশে ফেরত এসেছে, যা সবচেয়ে উচ্চ রিটার্নধারী বিনিয়োগের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নীতিগত প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়, যখন সরকার ১৯৪৭ সালের আইন সংশোধন করে রপ্তানি-সম্পর্কিত কোম্পানিগুলোর জন্য শর্তসাপেক্ষ পুঁজি স্থানান্তরের অনুমোদন দেয়। তবে কেবল রফতানিকারক বা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস থাকা কোম্পানিগুলিই এই সুবিধা পায়, এবং প্রতিটি বিনিয়োগের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন ও জিডিপি বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিবেচনায় বিদেশে পুঁজি স্থানান্তরের নীতি পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। দেশের বেকারত্ব বাড়ছে, উৎপাদনশীল বিনিয়োগ কমছে—এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় অর্থনীতিতে পুঁজির প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি বলে তারা মনে করেন।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান
বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিদেশে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়লেও বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে সংযত নীতি অনুসরণ করছে। এটি একদিকে মূলধনপলায়ন ঝুঁকি কমাচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয় বিনিয়োগের ঘাটতি পূরণে আরও কার্যকর প্রণোদনার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে বিনিয়োগের সাফল্য নির্ভর করে কেবল অনুমোদন নয়, বরং বিনিয়োগের প্রকৃতি, বাজারে প্রবেশ কৌশল, এবং আয়ের পুনঃপ্রবাহের উপর। যদি এসব বিনিয়োগ কাঠামোগতভাবে পর্যবেক্ষণ ও ফলপ্রসূ করা যায়, তাহলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন উৎস হতে পারে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/৮ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 weeks আগে

