বিপ্লব মোহন্ত ●
মরিচ ছাড়া আমরা কোনো তরকারি রান্না কল্পনাই করতে পারি না। শুধু আমাদের দেশে নয়, এটি বিশ্বের অনেকে দেশেই একটি জনপ্রিয় সবজি। ঘরে ঘরে রান্নার কাজে কাঁচা মরিচকে একটি অত্যাবশকীয় উপাদান বলা যায়। যদিও প্রয়োজন হয় সামান্য। তবে মাঝে মধ্যেই এই মরিচের ঝাল অর্থাৎ বাজার মূল্য এত বেড়ে যায় যে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে না।
দেশে জুলাই-অক্টোবর এই চার মাসে কাঁচা মরিচের উৎপাদন কমে আসে। মূলত: আবহাওয়ার কারণে এ সময় ফলন কমে আসে ২০২০ সাল থেকে। দামের তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, জুলাই-আগস্ট মাসে কাঁচামরিচের দাম গড়ে ১৫০-২৫০ টাকার মধ্যে ছিল। ২০২১-২২ সালে আমদানি ছিলো ৭৪৬৭ মে.টন এবং ২০২২-২৩ সালে ২ হাজার ২১ টন। ২২-২৩ অর্থ বছরে দেশে ১.৫৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে কাঁচা মরিচের আবাদ হয়েছে এবং ২৩-২৪ অর্থ বছরে ১.৬৩১ লক্ষ হেক্টর জমিতে। মরিচ উৎপাদন বাড়ছে। ২০২৪ সালে এপ্রিল-জুন মাসে প্রচন্ড খরা ও গরমে মরিচ গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ফলন কম হয়েছে। এরপর ভারী বর্ষণের কারণে মরিচ গাছ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জুলাই-আগষ্ট মাসে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে কাঁচা মরিচের দাম গড়ে কেজি প্রতি ৭০০-৮০০ টাকায় দাঁড়ায়।
কাঁচা মরিচ শরীরের অনেক উপকার করে। কাঁচা মরিচে থাকে ক্যাপসাইসিন, যা মূলত মরিচকে ঝাল করতে ভূমিকা রাখে। কাঁচা মরিচে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন-সি, কে, বি-৬, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, নিয়াসিন, সোডিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি খনিজ উপাদান। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর ডায়াটারি ফাইবার, পানি, অল্প পরিমাণ কার্বোহাইড্রেড ও প্রোটিন। কাঁচা মরিচের অণুজীব প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে জীবাণু সংক্রমণ রাখতে সাহায্য করে, ভিটামিন এ থাকায় তা সব বয়সী ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে ও চোখ ব্যথা দূর করে, এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে ফলে তা ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করতে এবং খাবার ভালো হজমে সাহায্য করে কাঁচা মরিচ। প্রতিদিন কাঁচা মরিচ খেয়ে ঠান্ডা, কাশি এমনকি ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। কাঁচা মরিচ টিস্যু পুনর্গঠন করে, নতুন রক্তকোষ তৈরি করে, হাড়কে সুস্থ ও শক্তিশালী করে। যারা নিয়মিত কাঁচা মরিচ খান, তাদের ত্বক থাকে বলিরেখামুক্ত। এটি বয়স ধরে রাখতে জাদুকরি একটি উপাদান। কাঁচামরিচ বাড়তি মেদ ঝরায়। বিপাকক্রিয়ার উন্নতি করে ওজন কমানোতে সাহায্য করে। এটি মস্তিষ্কে এনডোরফিন হরমোন বাড়ায়। এই হরমোন উদ্দীপক। মন ভালো রাখতে কাঁচা মরিচে ক্যাপসাইসিন রয়েছে যা পাকস্থলীর ক্যানসার ও পাকস্থলীর যে কোনো রোগ নিরাময়ে সহায়তা করে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে মোট পরিবার সংখ্যা ৪১০০৮২১৭। তার মধ্যে শহরে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ১৩১৮৮৭৭২ এবং পল্লী এলাকায় ২৭৮১৯৪৪৫। শহরে প্রতি পরিবারে গড় সদস্য সংখ্যা ৩.৭১ জন। দেশের ১৮০১৫৪৬৯ পরিবার পাকা বাড়িতে বসবাস করে। এসব বাসস্থানের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খানাতে পূর্ব বা দক্ষিণ মুখী বারান্দা রয়েছে। এই বারান্দাগুলিতে ২টি করে মরিচ গাছ রোপণ করলেই বাড়ী বা ফ্লাটে বসবাসকারী পরিবারের দৈনিক কাঁচা মরিচের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। অর্থনৈতিকভাবে ভোক্তার জন্যও তা সাশ্রয়ী। বারান্দাগুলিতে পর্যাপ্ত রোদ প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে যা মরিচ উৎপাদনে সহায়ক হতে পারে। তথ্য মতে, প্রতি জনের জন্য প্রতিদিন গড়ে ৭.১৯ গ্রাম কাঁচা মরিচ প্রয়োজন হয়। তাহলে পরিবারে গড় সদস্য সংখ্যা ৩.৭১ জন হলে প্রতি পরিবারে দৈনিক কাঁচা মরিচের চাহিদা দাঁড়ায় ২৬.৬৭ (প্রায় ২৭) গ্রাম। উফশী বা স্থানীয় জাতগুলির প্রতি মরিচের ওজন ২-৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতি মরিচের ওজন গড়ে ৩.৫ গ্রাম। এ হিসেবে প্রতি পরিবারের জন্য উফশী বা স্থানীয় জাতের ৮টি মরিচ প্রয়োজন হবে। বাড়ীতে যদি দুইটি মরিচ গাছ থাকে। প্রতি গাছে গড়ে ৪৫০-৫০০টি মরিচ হবে। ২টি গাছের মরিচ থেকে প্রায় ৪ মাস পারিবারিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। আর যদি হাইব্রিড মরিচের চারা রোপণ করা যায় তবে প্রতিটি মরিচের গড় ওজন হয় ৫ গ্রাম। সে হিসেবে পরিবার প্রতি মরিচ প্রয়োজন হয় মাত্র ৬টি। অর্থাৎ ২টি গাছের মরিচ দিয়ে ৬ মাস কাঁচা মরিচের চাহিদা পূরণ সম্ভব। সারা দেশে পাকা বাড়ীতে বসবাসকারী পরিবারের মাত্র ১ শতাংশ বা ১৮০১৫৫ পরিবারকে এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করলে প্রতিদিন ৪.৮ মে.টন মরিচ কম প্রয়োজন হবে ও ২ শতাংশ বা ৩৬০৩১০ পরিবার এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করলে প্রতিদিন ৯.৬ মে.টন মরিচ কম প্রয়োজন হবে। সারা দেশে পাকা বাড়ী বা ফ্লাট বাসায় বসবাসরত পরিবারকে এই কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় প্রায় ১৪০৩২ জন উপ সহকারী কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। প্রত্যেক উপ সহকারী কর্মকর্তা ১০০ পরিবারকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে পারলে প্রায় ১৪০৩২০০ পরিবার বাড়ীতে উৎপাদিত কাঁচা মরিচ ব্যবহার করতে পারবেন। এর ফলে দেশে দৈনিক প্রায় ৩৮ টন কাচা মরিচ বাজার থেকে কেনার প্রযোজন হবে না। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে কাঁচা মরিচের বাজার অস্থিতিশীল হবে না। ফলে মরিচের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হতে পারে।
ঢাকা শহরে অট্টালিকায় কৃষি কাজ অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এই কাজটি করতে যদি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা যায় তাহলে কাঁচা মরিচের বাজার কখনই ৮০০-১০০০ টাকা কেজি হবে না। ঢাকায় মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা আনুমানিক ৬১০০০০০। এই ফ্লাটগুলির মোটামুটি অর্ধেকের পূর্ব বা দক্ষিণমুখি বারান্দা রয়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩০০০০০ ফ্লাটে মরিচ উৎপাদন সম্ভব। এসব ফ্ল্যাটের ১০% এ মরিচ হলে ৩০,০০০০ পরিবার মরিচ ক্রয় করতে হবে না। একইভাবে ২০% হলে ৬০,০০০০, ৩০% হলে ৯০,০০০০, ৪০% হলে ১,২০,০০০০ পরিবারের কাঁচা মরিচ ক্রয়ের প্রয়োজন হবে না। এসব ফ্ল্যাটের বারান্দায় প্রতিদিন ৯ থেকে ৩৬ টন মরিচ উৎপাদন সম্ভব হতে পারে। ঢাকা শহরে মরিচের বাজার স্থিতিশীল রাখতে তা কার্যকর ভুমিকা রাখবে।
বারান্দায় মরিচ চাষের ক্ষেত্রে মাটি অথবা প্লাস্টিকের টব ব্যবহার করা উত্তম। এছাড়া পলিব্যাগ, টিনের কৌটা বা প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। মরিচ গাছের জন্য মাঝারি আকৃতির টব হলেই চলে। মাঝারি আকৃতির টবে মরিচ গাছের চাষ করা সম্ভব। মাটি প্রস্তুত মরিচ চাষের জন্য দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। এছাড়া সামান্য ক্ষারীয় মাটি ব্যবহার করা যেতে পারে। দোআঁশ মাটির সঙ্গে জৈব সার ভালো করে মিশিয়ে টব ভর্তি করতে হবে। তারপর টবের এই মাটিতে যথেষ্ট পানি দিতে হবে, যাতে মাটি ভেজা ভেজা থাকে। তাছাড়া লক্ষ্য রাখতে হবে মাটি যেন একেবারে শুকিয়ে না যায় এবং আদ্রস্থানে তা রাখতে হবে।
ঢাকা শহরের বায়ু দেশের মধ্যে সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর। কারণ এ শহরে বাস করে ২.৩২ কোটি লোক। বিশাল এ জনসংখ্যার শহরে গাছের সংখ্যা কমে গেছে আশংকাজনকভাবে। গাছপালা কমে যাওয়ায় বাতাসে দূষণকারী গ্যাসগুলির পরিশোধনের সুযোগ কমে যায়। মানুষ, যানবাহন এবং বিভিন্ন কল কারখানা থেকে নির্গত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কার্বনডাই অক্সসাইডসহ আরো অনেক বিষাক্ত গ্যাস। যা বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। বায়ু নির্মল করার জন্য ব্যাপক পরিমাণ বৃক্ষ রোপণ প্রয়োজন। অনেকেই বাড়ীতে আমরা শখের বশে বিভিন্ন ধরনের গাছ রোপন করি। একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বনডাই অক্সসাইড গ্রহণ করে এবং সোয়া ৬ কেজি অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশকে নির্মল রাখতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে টবে মরিচ উৎপাদন অক্সিজেন সরবরাহ এবং কার্বনডাই অক্সসাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল রাখতে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। ●
লেখক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর উপপরিচালক
অকা/নিলে/কৃশি/দুপুর/১১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে

