অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আদায়ে গতি দেখা গেলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে এখনো বেশ পিছিয়ে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। জুলাই থেকে নভেম্বর—এই প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায়ে সোয়া ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ঘাটতির চক্র ভাঙতে পারেনি সংস্থাটি। এই সময়ে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ফলে পাঁচ মাসেই রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে এসব চিত্র উঠে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক হলেও বাস্তবে তিনটি প্রধান রাজস্ব খাতের কোনোটিই নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আলোচ্য পাঁচ মাসে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায় থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) থেকে আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। আর আয়কর ও ভ্রমণ কর মিলিয়ে আদায় হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভ্যাট খাত, যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আয়কর খাতে প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ের শুল্কে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।
তবে প্রবৃদ্ধির এই চিত্র সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো—জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর—এই তিন প্রধান খাতের কোনোটি থেকেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে আয়কর খাতে। পাঁচ মাসে এই খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, অথচ আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।
আমদানি পর্যায়েও চিত্র খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। জুলাই–নভেম্বর সময়ে আমদানি খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। বাস্তবে এই লক্ষ্যের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে প্রায় ৮ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে ভ্যাট খাতে পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা।
এনবিআর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কার্যক্রমে শ্লথগতি থাকায় রাজস্ব আদায় প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে। আমদানি কমে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ ভোগ ব্যয় চাপে থাকা এবং করজালের বিস্তার কাঙ্ক্ষিত হারে না বাড়ার প্রভাব রাজস্ব আদায়ে স্পষ্টভাবে পড়েছে।
মাসভিত্তিক হিসাবেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। শুধু নভেম্বর মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি। এই মাসে ৩৬ হাজার ৩২৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে আদায় হয়েছে মাত্র ২৯ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। ফলে এক মাসেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। যদিও নভেম্বর মাসে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ, তবু লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ব্যবধান রয়ে গেছে উল্লেখযোগ্য।
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশের সমান। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের কথা রয়েছে অন্যান্য উৎস থেকে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থবছরের শুরুতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও বড় অঙ্কের ঘাটতি ইঙ্গিত দিচ্ছে কাঠামোগত দুর্বলতার দিকে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার, করজালের সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি না এলে চলতি অর্থবছরের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা এনবিআরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। ●
অকা/রা/ই/সকাল/২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে

