অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

দেশের পুঁজি বাজারে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নতুন কোনো কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন পায়নি। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে শিল্প খাতে পুঁজি বাজার থেকে অর্থায়ন বন্ধ হয়ে আছে। অথচ অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যেসব কোম্পানি বাজার থেকে অর্থ নিয়েছিল, তাদের অনেকে এখন সংগৃহীত তহবিল ব্যবহার করতে হিমশিম খাচ্ছে। গত এক বছরে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় অনেক কোম্পানি তহবিল ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছে কিংবা ধীর গতিতে বিনিয়োগ করেছে।

গত ১০ বছরে পুঁজি বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা অন্তত দুই ডজন কোম্পানির মধ্যে অনেকে নির্ধারিত সময়েও আইপিও তহবিল শেষ করতে পারেনি। কেউ কেউ বারবার সময় বাড়ালেও সেই অর্থ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার কিছু কোম্পানি আংশিক ব্যবহার করলেও তা লক্ষ্য অনুযায়ী খুবই সামান্য। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কয়েকটি কোম্পানি তাদের উত্তোলিত অর্থের এক টাকাও কাজে লাগাতে পারেনি।

এই অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি আইপিও তহবিল ব্যবহার করেছে বেস্ট হোল্ডিংস পিএলসি। কোম্পানিটি ৩৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৭৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা মোট তহবিলের ২২ শতাংশ। টেকনো ড্রাগস লিমিটেড শতকোটি টাকার আইপিও তহবিল থেকে ৬৪ কোটি টাকা ব্যবহার করেছে, অর্থাৎ প্রায় ৬৪ শতাংশ। তবে বড় অঙ্কের তহবিল সংগ্রহকারী গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৪২৫ কোটি টাকার বিপরীতে ব্যবহার করেছে মাত্র ৬ কোটি টাকা, যা ১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম খুঁজে না পাওয়া, এসএমই খাতে সীমিত সম্ভাবনা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতার কারণে তারা পরিকল্পনামাফিক অর্থ ব্যবহার করতে পারেনি।

এ ছাড়া সিকদার ইন্স্যুরেন্স তাদের সংগৃহীত ১৬ কোটি টাকার মধ্যে ব্যবহার করেছে মাত্র ২ কোটি টাকা, যা ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস ৭৫ কোটি টাকার মধ্যে ব্যবহার করেছে মাত্র ৮ কোটি টাকা, যা ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আবার সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস, একমি পেস্টিসাইড ও আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেড গত অর্থবছরে তাদের উত্তোলিত অর্থের এক টাকাও কাজে লাগাতে পারেনি। এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, জেএমআই হসপিটালসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি আংশিক ব্যয় করলেও তা ছিল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম।

অর্থনীতিবিদ ও পুঁজি বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ মনে করেন, অনেক কোম্পানি সঠিক উদ্দেশ্য ছাড়া আইপিওতে এসেছে। তারা মনগড়া ব্যয় পরিকল্পনা তৈরি করে অনুমোদন নিয়েছে, অথচ কোথায় অর্থ ব্যয় হবে বা মুনাফা আসবে—সেটা ভেবে দেখেনি। এর ফলে কিছু কোম্পানি আইপিওর অর্থ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিকর। তিনি অভিযোগ করেন, অতীতে প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীদের সুবিধা দিতে অনেক কোম্পানিকে পুঁজি বাজারে আনা হয়েছিল। ফলে এখন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আইপিওর অর্থ দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিবর্তে নিজেদের প্রভাব খাটাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিনের মতে, ব্যবসায়ীরা মূলত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অপেক্ষায় আছেন। তারা মনে করছেন, নির্বাচিত সরকার এলে বিনিয়োগে আসবেন। তবে তার মতে, ব্যবসায়িক পরিবেশে বড় ধরনের ঘাটতি নেই। বরং দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যারা অতীতে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ নিয়েছিল, তারাই এখন সমস্যায় পড়ছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আইপিও প্রক্রিয়ায় দায়সারা কাজ করার সুযোগ থাকবে না। ইস্যু ম্যানেজার, অডিট ফার্ম, স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা—সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হচ্ছে। এতে নতুন করে বাজারে আসা কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, কিছু কোম্পানি আইপিওর নামে প্রিমিয়ামে শেয়ার ইস্যু করে অধিক অর্থ তুলেছে, কিন্তু সেই অর্থ কার্যকর বিনিয়োগে ব্যবহার করেনি। তারা নামমাত্র লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সান্ত্বনা দিয়েছে, অথচ পেছনে ছিল কর ফাঁকি ও অসৎ উদ্দেশ্য। এ জায়গাগুলোতে সংস্কার প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ভালো কোম্পানিগুলোকে পুঁজি বাজারে আনতে হলে আইপিও প্রক্রিয়ার সংস্কার অপরিহার্য। দীর্ঘদিন আইপিও শূন্য থাকার পর এখন সংস্কার হলে কেবল যোগ্য কোম্পানিগুলোই বাজারে আসবে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র আবুল কালাম জানিয়েছেন, এখন থেকে কোনো দুর্বল কোম্পানিকে আর অনুমোদন দেওয়া হবে না। পাবলিক ইস্যু রুলসসহ সব বিধান মেনে আইপিওতে আসতে হবে। সংস্কার শেষ হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করবে এমন মানসম্পন্ন কোম্পানিই তালিকাভুক্ত হবে।

সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, আইপিও থেকে উত্তোলিত তহবিল যথাযথভাবে ব্যবহার না হওয়া দেশের পুঁজি বাজারের জন্য উদ্বেগজনক সংকেত। এতে শুধু শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না, সাধারণ বিনিয়োগকারীর আস্থাও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কঠোর তদারকি ও কার্যকর সংস্কারই এই স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং ভবিষ্যতে একটি সুস্থ ও টেকসই পুঁজি বাজার গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। 
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 2 days আগে

Leave A Reply

Exit mobile version