অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে গঠিত ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও শেয়ার বাজার থেকে পূর্ববর্তী ব্যাংকগুলোকে অপসারণের প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। এতে হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী অনিশ্চয়তার মধ্যেই অপেক্ষায় আছেন, কারণ একীভূতকরণের পর ডিলিস্টিং হওয়ার বিষয়টি একটি মৌলিক ধাপ হলেও তা এখনও অগ্রসর হয়নি।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর স্পষ্ট বক্তব্য—ডিলিস্টিং প্রক্রিয়া শুরু করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে প্রথমে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দিতে হবে। কিন্তু পাঁচ ব্যাংকের কেউই এখনো এমন আবেদন করেনি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)–ও জানিয়েছে, ডিলিস্টিং নিয়ে তারা কোনো নির্দেশনা বা যোগাযোগ পায়নি। বাজারবিধি অনুযায়ী এক্সচেঞ্জ একতরফাভাবে কোনো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে ডিলিস্ট করতে পারে না; এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন এবং ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উদ্যোগ—দুটি প্রক্রিয়াই বাধ্যতামূলক।

বিষয়টি আরও জটিল করেছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিয়ে বিভ্রান্তি। একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলোর একজন প্রশাসক দাবি করেছেন, ডিলিস্টিংয়ের সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারবেন না এবং এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করেছে—শেয়ারবাজার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত তাদের আওতায় পড়ে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ব্যাংকগুলো এখন ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর অধীনে কাজ করছে, তাই তালিকা বাতিলের সিদ্ধান্ত নতুন সত্তার বোর্ডই নেবে। তিনি আরও জানান, প্রথমবার তালিকাভুক্ত ব্যাংককে নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করায় প্রক্রিয়াটিতে কিছু বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক, তবে সব পক্ষের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

যদিও নতুন ব্যাংকটি লাইসেন্স পেয়েছে, এর সাংগঠনিক কাঠামো এখনও পুরোপুরি দাঁড়ায়নি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিব নিয়োগ না পাওয়ায় ৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য বোর্ড সভা স্থগিত হয়। এর আগে ৩০ নভেম্বর গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে বিশেষ বোর্ড সভায় পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় এবং ১ ডিসেম্বর নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স হস্তান্তর করা হয়।

নতুন প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে সরকার এবং বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের মাধ্যমে। অনুমোদিত মূলধন ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে ঢাকার মতিঝিলে সেনা কল্যাণ ভবনে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।

ডিলিস্টিংয়ের প্রচলিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী, কোম্পানিকে শেয়ারগুলোর মূল্যায়ন করে ফ্রি-ফ্লোট শেয়ার ফেরত কেনার প্রস্তাব দিতে হয়। সম্প্রতি বেক্সিমকো সিনথেটিক্স ১০ টাকা দরে শেয়ার বাইব্যাক করে তালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুরবস্থা বিবেচনায় একই প্রক্রিয়া এখানে কার্যকর হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ৬ নভেম্বর থেকে স্থগিত রয়েছে। তাদের সম্মিলিত বাজার মূলধন বর্তমানে ১,৩২৯ কোটি টাকা এবং মোট শেয়ারের সংখ্যা ৫৮২ কোটি। মালিকানা কাঠামোর বৈচিত্র্য ডিলিস্টিং–সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে আরও জটিল করেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দখল ৬৫.০৫ শতাংশ, যেখানে স্পন্সর শেয়ার মাত্র ৫.৯০ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দখল ৬৯.৫০ শতাংশ, সাধারণের কাছে ১৮.৯৭ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকে স্পন্সরদের মালিকানা ৫৪.৪৯ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ নেই এবং ৫৩.৩৭ শতাংশ মালিকানা প্রাতিষ্ঠানিক। তুলনামূলক সুষম কাঠামো রয়েছে এক্সিম ব্যাংকে, যেখানে স্পন্সরদের দখল ৩২.৪৪ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩৯.৩১ শতাংশ।

এত বৈচিত্র্যময় শেয়ারহোল্ডিং ও নিয়ন্ত্রক ধাপের অস্পষ্টতা মিলিয়ে একীভূত পাঁচ ব্যাংকের ডিলিস্টিং এখন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে—যার সমাধান নির্ভর করছে নতুন ব্যাংকের বোর্ডের সিদ্ধান্ত ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 4 days আগে

Leave A Reply

Exit mobile version