তারেক আবেদীন ●
দেশের ছয়টি জীবন বীমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের পাওনা ৩ হাজার কোটি টাকা। এ অঙ্ক ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর অবধি। এরমধ্যে গ্রাহক প্রায় ২৫০০ কোটি টাকাই পাবে তৃতীয় প্রজন্মের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর কাছে। পাওনা টাকার মধ্যে অধিকাংশই রয়েছে গ্রাহকের বীমা দাবী সংক্রান্ত।
যথাসময়ে বীমা দাবী পরিশোধে ব্যর্থ বাকি ৫টি কোম্পানি হলো গোল্ডেন লাইফ ইনসিওরেন্স লিমিটেড, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড, বায়রা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড ও সানলাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড। খবর বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর বিশ্বস্ত একটি সূত্রের। বেশ কয়েক বছর ধরে গ্রাহকের মেয়াদোত্তীর্ণ ও মৃত্যুদাবীসহ বিভিন্ন পাওনা আদায়ের জন্য কোম্পানিগুলোর কাছে ধর্ণা দিচ্ছে গ্রাহক। স্বাভাবিকভাবে পাওনা না পেয়ে গ্রাহক আইডিআরএ’র কার্যালয়ে অভিযোগ পেশ করে আসছে। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে অভিযোগের এ তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০০০ সালে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে শুরু করা বেসবকারি জীবন বীমা কোম্পানি গোল্ডেন লাইফ ইনসিওরেন্স লিমিটেড কার্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আইডিআরএ বিব্রত অবস্থার মধ্যে পড়ে। দেশের তৃতীয় প্রজন্মের জীবন বীমা কোম্পানিটি গ্রাহক পাত্তনা নিয়ে কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সঙ্গে একাধিকবার বিরোধে জড়ায়। রাজধানীর ৯৯ মহাখালীস্থ এ্যামবন কমপ্লেক্সস্থ গোল্ডেন লাইফ অফিসে কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা গ্রাহকদের হাতে হেনস্তা হন। বিক্ষুব্ধ গ্রাহকদের ভয়ে গোল্ডেন লাইফ ইনসিওরেন্স লিমিটেড এ কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সর্বশেষ হিসাব অনুয়ায়ী গ্রাহক ও অন্যান্য পাওনাদার গোল্ডেন লাইফের কাছে পাবে ৩৪ কোটি টাকা; অথচ সম্পদ আছে মাত্র ২১ কোটি টাকার। গোল্ডেন লাইফ ইনসিওরেন্স লিমিটেড নামেই সোনালী সুদিন। গোল্ডেন লাইফের চলছে বেশ দুর্দিন। পাওনা নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরানো ও টালবাহানায় ভূক্তভোগী গ্রাহকেরা বেশ অর্থকষ্টের মধ্যে আছেন।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (রায়রা) এর ২৫৩ সদস্য মিলে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ এপ্রিল বায়রা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড গঠন করে। কদিন পর কোম্পানিটি বীমা কার্যক্রম শুরু করে। অথচ প্রায় ২৫ বছরেও কোম্পানিটি সাফল্য দেখাতে পারেনি। কোম্পানির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র অর্থকাগজকে জানায়, সর্বশেষ হিসাব অনুয়ায়ী বায়রা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর কাছে গ্রাহক ও অন্যান্যদের পাওনা ৭০ কোটি টাকা। সম্পদ ও নগদ তহবিল মিলিয়ে কোম্পানির রয়েছে ১০৫ কোটি টাকা।
এদিকে গোল্ডেন লাইফ ইনসিওরেন্স লিমিটেড এবং বায়রা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড ২০২৫ সালে বীমা ব্যবসায়ের লাইসেন্স নবায়ন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এ জন্য ৫ মার্চ কোম্পানি দুটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যানের কাছে আইডিআরএ’র পরিচালক (নিবন্ধন ও ব্যবস্থাপনা, লাইফ) আহম্মদ এহসান উল হান্নান স্বাক্ষরিত আলাদা আলাদাভাবে কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, আইডিআরএ বীমা গ্রাহকের পাওনা নিষ্পত্তির ব্যাপারে বেশ তৎপর হয়েছে। কোম্পানিগুলোর গ্রাহক পাওনা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলমের নেতৃত্বে কর্তৃপক্ষের প্রশাসন, আইন, লাইফ ও নন লাইফের সদস্যসহ ৬টি কোম্পানির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান হিসাব কর্মকর্তা ও কোম্পানি সচিবদের নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে ১০ সদস্য বিশিষ্ট দ্বিপাক্ষিক সভা আইডিআরএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ ২৩ মার্চ রোববার ছিল বায়রা, সানলাইফ ও পদ্মা ইসলামী লাইফের সভা।
আইডিআরএ’র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অর্থকাগজকে জানান, কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ সময় ধরে গ্রাহকদের পাওনা সংক্রান্ত অনিষ্পন্ন বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কর্মকর্তা দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, কোম্পানিগুলোকে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করতেই হবে। কোনো মাফ হবে না। কাউকে এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হবে না। এ জন্য কোম্পানিগুলোকে দ্রুত কার্যকর কর্ম পরিকল্পনা প্রদানের জন্য ৭ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ কটি কোম্পানির পরিচালকগণ আইডিআরএকে জানিয়েছেন জমি ও সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করবেন তারা।
অপর একটি সূত্র জানায়, গ্রাহকদের বীমা দাবী যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থতার তালিকায় তৃতীয় প্রজন্মের জীবন বীমা কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর অবস্থান ফারইষ্টের পরেই। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না অনেক বছর ধরেই। এরই মধ্যে কোম্পানিটির লাইফ ইন্স্যুরেন্স ফান্ড ঋণাত্মক হয়ে গেছে। কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে নানা অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে নিরীক্ষক। কোম্পানিটির ভবিষ্যতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা বা পরিচালনা করার সক্ষমতা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কোম্পানিটির সর্বশেষ ২০২৩ সালের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষায় এ তথ্য দেয় নিরীক্ষক। নিরীক্ষকের হিসাব অনুয়ায়ী, বীমা কোম্পানিটির লাইফ ইন্স্যুরেন্স ফান্ড ঋণাত্মক ২৫৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা। কোম্পানিটির ২০২৩ সালে পরিচালন নগদ প্রবাহ হয়েছে ঋণাত্মক ১৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই দুই ঋণাত্মক হিসাব কোম্পানিটির ভবিষ্যতে ব্যবসা পরিচালনা করার সক্ষমতাকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কোম্পানিটিতে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বীমা দাবী দাঁড়িয়েছে ২২৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে তা আরো বেশি।
অনিরীক্ষিত হিসাব অনুয়ায়ী সানলাইফের কাছে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বীমা গ্রাহকদের পাওনা ৪০০ কোটি টাকা। সানফ্লাওয়ার লাইফ এবং হোমল্যান্ড লাইফের অবস্থাও শোচনীয়। প্রতিদিন গ্রাহক কোম্পানি দুটিতে পাওনা অর্থের জন্য ভীড় করছে। কোম্পানি দুটিতেও গ্রাহক পাওনার পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর বীমা গ্রাহকদের অনিষ্পন্ন মেয়াদপূর্ণ দাবীর পরিমাণ ১৫৭ কোটি টাকা।
প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুল আমিন অর্থকাগজকে জানান, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রাহক দাবী নিষ্পত্তির বিষয়ে আমাদের সভা হয়েছে। সভায় আইডিআরএ কটি নির্দেশনা দিয়েছে আমাদের কোম্পানিকে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত দাবী বাবদ প্রগ্রেসিভ লাইফের কাছে গ্রাহক পাবে ১৫০ কোটি টাকা। ●
অকা/জীবীকো/বিপ্র/বিকেল/২৩ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে