অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়তে থাকায় প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিও ক্রমশ গভীর হচ্ছে। ঋণ জালিয়াতি, শিথিল নজরদারি, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং বছরের পর বছর ধরে চলা অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে যেভাবে খেলাপির পাহাড় তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলার মতো পর্যাপ্ত মুনাফা অর্জন করতে পারছে না অধিকাংশ ব্যাংক। ফলে বাধ্যতামূলক প্রভিশন সংরক্ষণে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্যের একটি স্পষ্ট সংকেত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রভিশনের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা শুধু পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকের তুলনায়ই নয়, সামগ্রিকভাবে ঐতিহাসিক উচ্চতা স্পর্শ করেছে। জুনের শেষে এ ঘাটতি ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা; অর্থাৎ তিন মাসে ঘাটতি আরও প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রচলিত বিধান অনুসারে, ঋণ ‘নিম্নমান’ বা বিশেষ-উল্লেখযোগ্য হলে তার বিপরীতে ২০ শতাংশ, ‘সন্দেহজনক’ হলে ৫০ শতাংশ এবং ‘মন্দ’ হলে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এসব নিয়ম মেনে চলতে গেলে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট প্রভিশন প্রয়োজন ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তারা জমা রাখতে পেরেছে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, বাকিটাই ঘাটতি হিসেবে থেকে গেছে।
প্রভিশন রাখা ও স্থগিত সুদ—উভয়টির সম্মিলিত পরিমাণ জুনে ছিল ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর নাগাদ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকায়। এই অর্থ আয়ের খাতে স্থানান্তর করতে না পারায় ব্যাংকগুলোর লাভজনকতা সংকুচিত হচ্ছে, যা পুনরায় মূলধন সংকটকে তীব্র করছে।
এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণের আকার এমনভাবে膨 করেছে যে তা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ। জুনে এ হার ছিল ৩৪.৪০ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝা যায় গত এক বছরের তুলনামূলক বিশ্লেষণেই। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা—যা ছিল মোট ঋণের ১৬.৯৩ শতাংশ। এক বছরে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা—অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। গত বছরের ডিসেম্বরে এটি ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা; সেখান থেকে মাত্র নয় মাসে বৃদ্ধি ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ববর্তী সরকারের সময় ‘নীতিসহায়তা’ ও শিথিল মানদণ্ডের আড়ালে বড় ঋণগ্রহীতাদের জন্য নানা ছাড় ও সুবিধা তৈরি করা হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ সীমা বাড়িয়ে, অথবা সংশ্লিষ্ট গ্রুপের নামে নতুন ঋণ সৃষ্টি করে, অনাদায়ী ঋণকে কাগজে ‘নিয়মিত’ দেখানোর পথ খোলা ছিল। এতে প্রকৃত খেলাপির চিত্র আড়াল থাকলেও ব্যাংকের তহবিল ঝুঁকির মধ্যেই ছিল।
তবে গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ বহু বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা প্রকৃত খেলাপি পুঞ্জিভূত হয়ে এখন সামনে চলে এসেছে। নিয়ম-কানুন কঠোর হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিটে খেলাপির প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে প্রভিশন ঘাটতির বিশাল চাপও প্রকাশ্যে এসেছে।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে—তা নির্ভর করবে ব্যাংকগুলো কত দ্রুত অভ্যন্তরীণ সংস্কার, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, এবং খেলাপি আদায়ের ওপর পুনঃমনোযোগ দিতে পারে তার ওপর। তবে বর্তমান প্রবণতা বলছে, খাতটি আরও দীর্ঘ সময় কাঠামোগত চাপের মধ্যেই থাকতে পারে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 days আগে

