অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি ঋণ পরিশোধে খেলাপি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন থেকে, যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি ঋণে খেলাপি হবে, তাদের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই সিদ্ধান্ত বৈদেশিক ঋণের খেলাপি কমাতে এবং বাহ্যিক ঋণের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পূর্বে, সিআইবি শুধুমাত্র দেশীয় ঋণের খেলাপিদের তথ্য সংরক্ষণ করত, ফলে বিদেশি ঋণে খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজেই নতুন ঋণ নিতে পারত। এই নতুন নীতি এই ফাঁকফোকর বন্ধ করবে, যার ফলে খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
গত ২১ মে ২০২৫-এ স্ক্রুটিনি কমিটি অন ফরেন লোন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট-এর সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে এই সভায় বলা হয়, "বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি নিরুপণ ও খেলাপি হ্রাসে সিআইবি এখন থেকে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ ও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের তথ্য সংরক্ষণ করবে, যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান বিদেশি ঋণে খেলাপি হয়ে স্থানীয় উৎস থেকে কোনো সুবিধা নিতে না পারে।" এই পদক্ষেপের ফলে বিদেশি ঋণে খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ বন্ধ হবে, যা তাদের ঋণ পরিশোধে আরও দায়বদ্ধ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ সীমিত থাকলেও, সিআইবি'র মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা খেলাপিদের উপর পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এই উদ্যোগকে "নিঃসন্দেহে একটি যুক্তিসংগত পদক্ষেপ" হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, "বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য এ ধরনের তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্থানীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে।" তবে, তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এতদিন বিদেশি ঋণের খেলাপি তথ্য সিআইবি'র ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি আরও জানান, এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য কঠোর মনিটরিং এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান এই নিয়মের ফাঁকফোকর দিয়ে সুবিধা নিতে না পারে।
স্ক্রুটিনি কমিটির সভায় ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং থিয়েটার মেডিকেল বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের জন্য মোট ২০.২০ মিলিয়ন ডলারের নতুন ঋণ অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়া, ৯টি কোম্পানির প্রায় ৯৮৮ মিলিয়ন ডলারের পুরনো ঋণের রিপেমেন্ট সিডিউল এবং ফি ও চার্জ পরিবর্তনের প্রস্তাব এবং ১৩টি কোম্পানির ৩১৫.০৭ মিলিয়ন ডলারের ভূতাপেক্ষ ঋণ অনুমোদিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড (৩০০ মিলিয়ন ডলার), রবি আজিয়াটা পিএলসি (৯৫ মিলিয়ন ডলার আগাম পরিশোধ), উত্তরা ফুডস অ্যান্ড ফিডস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, এইচডিএফসি সিনপাওয়ার লিমিটেড, এবং নতুন বিদ্যুৎ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। এছাড়া, আইসিডি, আইডিসিওএল, এবং বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড থেকে নেওয়া ৯০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের ফি ও খরচ পরিবর্তনের প্রস্তাবও অনুমোদিত হয়েছে। ইউবিডি অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, শিমা সেইকি এমএফজি লিমিটেড, এবং বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ভূতাপেক্ষ অনুমোদন পেয়েছে। বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড তাদের ৮৩ মিলিয়ন ডলারের ঋণের 'অ্যাভেইলেবিলিটি পিরিয়ড' বৃদ্ধির অনুমোদন পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০.১৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধের দিকে ঝুঁকেছিলেন, কারণ ডলারের দর বৃদ্ধিতে তাদের বিনিময় হারের ঝুঁকি এবং লোকসান বেড়ে যাচ্ছিল। ফলে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই ঋণের স্থিতি ছিল ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কমে ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। তবে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিদেশি ঋণের পরিমাণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। ডলারের দর ৮৩-৮৪ টাকা থেকে ১২৩-১২৪ টাকায় উঠে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে বাড়তি চাপ পড়ছে। এছাড়া, লাইবর রেটের পরিবর্তে সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) কার্যকর হওয়ায় ঋণের ফি ও চার্জে পরিবর্তন এসেছে, যার জন্য কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআই-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টু জানান, চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে, অনেক কোম্পানি ঋণ পরিশোধে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, গত এক-দেড় বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না, যার ফলে ঋণের সময়সীমা বাড়ানো এবং বাড়তি ফি প্রদানের ঘটনা বাড়ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) স্ক্রুটিনি কমিটির কার্যক্রম পরিচালনা করে। ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক ঋণ অনুমোদন বা সংক্রান্ত বিষয়ে বিডায় আবেদন করেন। জরুরি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বিডা শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেয়, যা পরে কমিটি ভূতাপেক্ষ অনুমোদন করে। গত ২১ মে ২০২৫-এ সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়, যা তার আগের ২৮ জানুয়ারির সভার প্রায় চার মাস পর।
এই নতুন নীতি বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি বিদেশি ঋণের শৃঙ্খলা আনার পাশাপাশি স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে, এই নীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য কঠোর তদারকি, স্বচ্ছতা, এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/১৮ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 weeks আগে