অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
গত প্রায় ২৫ বছরে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে একের পর এক বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গভর্ন্যান্স ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় কাঙ্ক্ষিত মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। বরং অনুপাদনশীল খাতে ব্যয় করা বৈদেশিক মুদ্রার ঋণের বোঝা ক্রমশ বেড়েছে এবং সুদ পরিশোধের চাপের কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি) ধীরে ধীরে বিদেশি ঋণের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নির্ভরতায় আটকে পড়েছে—এমন মূল্যায়ন উঠে এসেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে ইআরডির কর্মকর্তারা এলজিডির আওতাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে অতীত প্রকল্পগুলোর সীমিত ফলাফল, উচ্চ সুদের হার এবং ভবিষ্যৎ বৈদেশিক দায়ের ঝুঁকি বিবেচনায় নতুন করে বা ধাপে ধাপে এসব প্রকল্প চালু রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে আপত্তি জানান তারা।
ইআরডির দৃষ্টিতে, গভর্ন্যান্স ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো খাতে উচ্চ সুদের বৈদেশিক ঋণ অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। উদাহরণ হিসেবে উপজেলা গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ইউজিডিপি) কথা তুলে ধরা হয়। প্রথম পর্যায়ে (ইউজিডিপি-১) যেখানে সুদের হার ছিল মাত্র ০.০১ শতাংশ, সেখানে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় পর্যায়ে (ইউজিডিপি-২) তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৩৫ শতাংশে। ইআরডির মতে, এই ধরনের প্রকল্পে এত উচ্চ সুদের বৈদেশিক ঋণ নেওয়া নীতিগত ও অর্থনৈতিক—দুই দিক থেকেই অযৌক্তিক।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত রিকভারি অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অব ইনফরমাল সেক্টর এমপ্লয়মেন্ট (রেইজ) প্রকল্প নিয়েও একই ধরনের সমালোচনা উঠে এসেছে। প্রায় ২,৪৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সাফল্য দেখাতে পারেনি বলে ইআরডির কর্মকর্তারা মত দেন। বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, প্রকল্পটির আওতায় মূলত কিছু উপকারভোগীকে এককালীন সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যা টেকসই আয় বা কর্মসংস্থান তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাইকার অর্থায়নে প্রস্তাবিত ইউজিডিপি-২ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ নেওয়ার বিষয়েও ইআরডি তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর শেরেবাংলা নগরে ইআরডির সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ইউজিডিপি-২–এর দ্বিতীয় বিস্তারিত ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের কিক-অফ সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, প্রকল্পটির দার্শনিক ভিত্তি ও অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা নিয়ে ইআরডি প্রশ্ন তুলেছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও আমেরিকা–জাপান উইংয়ের প্রধান ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। জাইকার পক্ষে মিশনের নেতৃত্ব দেন ফুজিই তেরুয়াকি।
ইআরডির মতে, স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি)-এর তিনটি ধাপ, ইউএনডিপির ইউনিয়ন পরিষদ গভর্ন্যান্স প্রজেক্ট (ইউপিজিপি) এবং জাইকার অর্থায়নে ইউজিডিপি-১ বাস্তবায়ন হলেও কাঠামোগত উন্নয়ন বা টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। বরং এসব প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ, কর্মশালা ও সেমিনারের মতো খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে, যা বাস্তব প্রশাসনিক সংস্কারে রূপ নেয়নি।
ইআরডির কর্মকর্তারা মনে করেন, পরামর্শকনির্ভর উন্নয়ন মডেল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। তাদের যুক্তি, একই লক্ষ্য সরকারি অর্থায়ন ও সুস্পষ্ট নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে আরও কম খরচে এবং বেশি কার্যকরভাবে অর্জন করা সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও এ ধরনের প্রকল্পে ঋণনির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক মত দিয়েছেন। তার ভাষায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সহায়তা বা অনুদান মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রয়োজনীয় হলেও, সেখান থেকে কোনো সরাসরি আর্থিক রিটার্ন আসে না। ফলে এসব ব্যয় বিদেশি ঋণের মাধ্যমে নয়, বরং রাজস্ব থেকে মেটানোই যুক্তিযুক্ত। একইভাবে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং বা লোকাল গভর্ন্যান্স প্রকল্প বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ায় না—এমন প্রকল্পে ঋণ নিলে ভবিষ্যতে পরিশোধের ঝুঁকি আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে।
ইআরডির বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, নীতিমালার ঘাটতির কারণে দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নযোগ্য বহু প্রকল্পও বিদেশি ঋণের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বৈদেশিক ঋণ ক্রমেই ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে এবং ভবিষ্যতে পরিশোধের চাপ বাড়ছে, যা সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগজনক।
ইউজিডিপি-২ প্রকল্পের বিরোধিতার পেছনে ইআরডি আর্থিক যুক্তি, প্রকল্পের কার্যকারিতা ও নীতিগত প্রশ্ন—এই তিনটিকেই মুখ্য হিসেবে দেখছে। ইউজিডিপি-১ প্রকল্পে যেখানে জাইকার ঋণ ছিল ১,১৫১.৫ কোটি টাকা, সেখানে ইউজিডিপি-২–এ প্রস্তাবিত ঋণের পরিমাণ ১৮৮.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২,৩১০ কোটি টাকা। এক দশক বাস্তবায়নের পরও যদি একই লক্ষ্য পূরণে নতুন করে আরেকটি প্রকল্প প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রথম প্রকল্পের সফলতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে—এমনটাই ইআরডির অবস্থান।
এ কারণে ইআরডি এলজিডিকে এলজিএসপি, ইউপিজিপি, ইএলএজি ও ইউজিডিপি-১ প্রকল্পগুলোর একটি সমন্বিত মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ সুদের বৈদেশিক ঋণের পরিবর্তে সরকারি অর্থায়নে ইউজিডিপি-২ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা যাচাইয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত রেইজ প্রকল্পও একইভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছে। কোভিড-১৯–পরবর্তী সময়ে ফেরত আসা প্রবাসীদের এককালীন ১৩,৫০০ টাকা সহায়তা দিয়ে টেকসই কর্মসংস্থান বা আয় নিশ্চিত করা যায়নি বলে ইআরডির পর্যবেক্ষণ। মাঠপর্যায়ে উপকারভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখা গেছে, এত স্বল্প অঙ্কের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব।
২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত চলমান রেইজ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ২০০ মিলিয়ন ডলার। এর একটি অংশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ঋণ হিসেবে বিতরণ করায় সরকার অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ রাখলেও, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে ফেরত অযোগ্য অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব নীতিগতভাবে অসংগত বলে মনে করছে ইআরডি।
সব মিলিয়ে ইআরডির মূল্যায়ন স্পষ্ট—বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত সংস্কার হয়নি, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বৈদেশিক ঋণের বোঝা আরও ভারী হচ্ছে। ●
অকা/প্র/ই/দুপুর/২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 days আগে

