অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

দেশের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক দুরবস্থার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে উঠছে ডিভিডেন্ড ঘোষণায়। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য অন্তত ৫৭টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি তাদের শেয়ার হোল্ডারদের কোনো ধরনের ডিভিডেন্ড না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানের একটি অংশ সরাসরি লোকসানে রয়েছে, আর বাকিগুলো মুনাফা অর্জন করলেও আগের বছরের জমাকৃত লোকসান ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ডিভিডেন্ড দিতে পারছে না। এ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি কোম্পানি তাদের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে শূন্য ডিভিডেন্ডের এই প্রবণতা বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।

খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শূন্য ডিভিডেন্ড ঘোষণাকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) রয়েছে। তবে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি চাপ দেখা যাচ্ছে উৎপাদন ও শিল্প খাতে। বিশেষ করে সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো এই তালিকায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে। মোট ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চলতি অর্থবছরের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড সুপারিশ করতে পারেনি। কয়েক বছর আগেও যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত লভ্যাংশ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রেখেছিল, এখন তারাই ধারাবাহিক লোকসান ও আর্থিক সংকটে পড়েছে।

বস্ত্র খাতের পরিস্থিতিও বেশ উদ্বেগজনক। ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৫৮টি বস্ত্র কোম্পানির মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান ২০২৫ অর্থবছরের জন্য ডিভিডেন্ড না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই খাতের অধিকাংশ কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে লোকসান বা নামমাত্র মুনাফার মধ্যে রয়েছে। কাঁচামালের উচ্চ মূল্য, জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়ায় বস্ত্র শিল্পের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক কোম্পানি সরাসরি লোকসানে না থাকলেও তাদের সংরক্ষিত আয় (retained earnings) নেতিবাচক হওয়ায় আইনগতভাবেই ডিভিডেন্ড দেওয়ার সুযোগ নেই। এর পেছনে রয়েছে মহামারি-পরবর্তী ধীরগতির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সুদের হার বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি। ফলে ব্যবসায়িক আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় মেটাতে।

সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট। বিদ্যুৎ, এনবিএফআই, ইঞ্জিনিয়ারিং ও খাদ্য খাতের একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবার ডিভিডেন্ড থেকে সরে এসেছে। অথচ মাত্র তিন বছর আগেও এসব কোম্পানির বড় একটি অংশ লাভজনক ছিল এবং শেয়ার হোল্ডারদের জন্য নিয়মিত লভ্যাংশ ঘোষণা করত। বর্তমানে লোকসান, উচ্চ দেনা ও ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা তাদের আর্থিক সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) টানা দ্বিতীয় বছরের মতো ডিভিডেন্ড না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ২০০৬ সালে পুঁজি বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এই প্রথম। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১২৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে এবং সামগ্রিকভাবে এর জমাকৃত লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকায়। বিদ্যুৎ খাতে উচ্চ উৎপাদন ব্যয় ও রাজস্ব ঘাটতি ডেসকোর আর্থিক অবস্থাকে আরও দুর্বল করেছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটি ডিভিডেন্ড না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাজারের দীর্ঘ মন্দা, দুর্বল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত এবং পোর্টফোলিওর অবমূল্যায়নের কারণে ২০২৫ অর্থবছরে আইসিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। অথচ ২০২৪ অর্থবছরেও তারা মাত্র ২ শতাংশ নগদ ডিভিডেন্ড দিতে পেরেছিল, যা একসময়কার উচ্চ ডিভিডেন্ড ইতিহাসের তুলনায় ছিল অনেক কম।

পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসিও টানা দ্বিতীয় বছরের মতো ডিভিডেন্ড না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একসময় এই কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে স্থিতিশীল ও আকর্ষণীয় ডিভিডেন্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে উচ্চ ব্যয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং আর্থিক চাপ তাদের সেই অবস্থান বদলে দিয়েছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ সার্ভিসেস, ন্যাশনাল টি, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, শ্যামপুর সুগার মিলস, উসমানিয়া গ্লাস, জিল বাংলা সুগার, অ্যাটলাস বাংলাদেশ, ইস্টার্ন কেবলস ও আজিজ পাইপসের মতো একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানও চলতি অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি।

বেসরকারি খাতেও চিত্র খুব একটা ভালো নয়। বস্ত্র খাতের ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস এককভাবে প্রায় ২২৪ কোটি টাকার লোকসান করেছে, যা গত তিন বছরে জমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০৬ কোটি টাকা। টানা লোকসানের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ডিভিডেন্ড দিতে ব্যর্থ হয়েছে; সর্বশেষ তারা ২০২২ সালে ১০ শতাংশ নগদ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। কাগজ শিল্পের বড় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা পেপার মিলস কাঁচামালের সংকট, ঋণের চাপ ও উৎপাদন ব্যয়ের কারণে এবারও ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারেনি। একইভাবে, লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রায় ৬৬ কোটি টাকার রেকর্ড লোকসান দেখিয়ে প্রথমবারের মতো ডিভিডেন্ড সুপারিশ থেকে সরে এসেছে।

সামগ্রিকভাবে শূন্য ডিভিডেন্ডের এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতির গভীর কিছু কাঠামোগত সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিনিয়োগ স্থবিরতা, উৎপাদনে বাধা, উচ্চ সুদ ও ডলার সংকট—সব মিলিয়ে কোম্পানিগুলোর আর্থিক ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থায়, যা পুনরুদ্ধার করতে হলে ব্যবসা পরিবেশে স্থিতিশীলতা, নীতিগত সহায়তা এবং করপোরেট ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এখন অত্যন্ত জরুরি।
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 6 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version