অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

দেশের শেয়ার বাজারে গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে এক ধরনের নজিরবিহীন স্থবিরতা জমে উঠেছে। টানা প্রায় ১৬ মাস কোনো নতুন কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি, এমনকি এই পুরো সময়ে একটি আইপিও আবেদনও নিয়ন্ত্রক সংস্থার টেবিলে জমা পড়েনি। করোনা মহামারির অচলাবস্থা বাদ দিলে গত দেড় দশকে দেশের পুঁজিবাজারে এমন দীর্ঘ ‘আইপিও শূন্যতা’ আর দেখা যায়নি। ফলে বাজারে নতুন বিনিয়োগযোগ্য কোম্পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ও আস্থা—দুটোই ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি মালিকানাধীন লাভজনক বহুজাতিক ও বড় কোম্পানিগুলোর শেয়ার দ্রুত পুঁজিবাজারে ছাড়ার যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা বাজারে নতুন গতি ফেরানোর ক্ষেত্রে একটি বড় প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই ঘোষণার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সরকারি পর্যায় থেকে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় বাজার সংশ্লিষ্টদের হতাশা আরও বেড়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সর্বশেষ কোম্পানি হিসেবে ‘টেকনো ড্রাগস’ বাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এরপর থেকে আইপিও অনুমোদন কিংবা নতুন তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া কার্যত থমকে আছে। ২০২৪ সালে টেকনো ড্রাগস ছাড়াও এনআরবি ব্যাংক, শিকদার ইনস্যুরেন্স ও এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজসহ মোট পাঁচটি কোম্পানি বাজারে এসেছিল। এরপর দীর্ঘ সময় কোনো নতুন কোম্পানি না আসায় বাজার অন্তত দুই বছর পিছিয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষক ও বাজার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নতুন কোম্পানি ছাড়া বাজারে বৈচিত্র্য, তারল্য ও বিনিয়োগের গতি—কোনোটিই টেকসইভাবে বাড়ানো সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হয় এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। বাজার সংস্কারের অংশ হিসেবে গত ৭ অক্টোবর একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়, যারা নতুন আইপিও আইন প্রণয়নের কাজ করছে। ‘পাবলিক অফার অব ইক্যুইটি সিকিউরিটিজ বিধিমালা, ২০২৫’ নামে প্রস্তাবিত এই বিধিমালার জনমত যাচাই ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে এবং শিগগিরই এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হতে পারে। তবে বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এই নতুন আইনের অপেক্ষা এবং অনিশ্চয়তার কারণেই অনেক সম্ভাব্য কোম্পানি আইপিও আবেদন থেকে সরে আছে।

বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম জানিয়েছেন, নতুন বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও পুরোনো বিধিমালা অনুযায়ী আইপিও আবেদনে কোনো আইনগত বাধা ছিল না। তার ভাষায়, মূল সমস্যা হচ্ছে অনেক কোম্পানির সুশাসনের ঘাটতি এবং বর্তমানে চালু থাকা ‘রেস্ট্রিকটেড প্রাইস মডেল’, যার কারণে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশিত মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। পাশাপাশি আগের কমিশনের সময়ে অনুমোদিত কিছু আইপিও আবেদনে গুরুতর অসংগতি পাওয়ায় বর্তমান কমিশন সেগুলো বাতিল করেছে। এসব কারণ মিলেই আইপিও প্রক্রিয়া আরও ধীর হয়ে পড়েছে। তবে সরকারি নির্দেশনার পরও বহুজাতিক ও বড় কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্ত না হওয়াকে বাজারের গতি ফেরানোর পথে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাজেদা খাতুন গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, সরকারি মালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে নীতিগত জটিলতা ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়া এগোচ্ছে না। এর পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বোর্ড অনুমোদনের জটিলতা এবং পর্যাপ্ত কর প্রণোদনার অভাবও আইপিওতে আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম মনে করেন, একটি অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক। তার মতে, এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির আরও সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন ছিল, যা এখনো দেখা যায়নি।

বর্তমান বাজার কাঠামোর আরেকটি বড় দুর্বল দিক হলো তালিকাভুক্ত কোম্পানির গুণগত মান। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৮৪টি কোম্পানির মধ্যে ১০২টিই ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে, যা মোট কোম্পানির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। উদ্বেগজনক তথ্য হলো—সাবেক দুই চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের মেয়াদে অনুমোদিত কোম্পানিগুলোর প্রায় ৩৫ শতাংশই এখন এই দুর্বল তালিকায় চলে গেছে। ভালো মানের, সুশাসিত ও লাভজনক কোম্পানির তীব্র সংকটের কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও নড়বড়ে হচ্ছে এবং বাজারের দীর্ঘস্থায়ী মন্দাভাব কাটানো কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে

Leave A Reply

Exit mobile version