অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
ঘুষ–দুর্নীতি কমানো ও হয়রানি দূর করার উদ্দেশ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট রিফান্ড ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর রিফান্ড প্রক্রিয়া পুনরায় চালু হলেও বাস্তবে অনলাইন ব্যবস্থাই এখন ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইভাস (Integrated VAT Administration System) সফটওয়্যার আবেদন জমার চাপের কারণে বারবার হ্যাং হয়ে যাচ্ছে, ফলে বহু প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় নথি আপলোড করতে পারছে না। নথি জমা না হলে আবেদন গ্রহণই হচ্ছে না, যা ব্যবসায়ীদের মূলধন আটকে দিয়ে তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় সরাসরি চাপ সৃষ্টি করছে।
এনবিআর ১০ নভেম্বর নতুন পরিপত্র জারি করে জানায়, যেসব আগাম করের সময়সীমা ৬ মাস অতিক্রম করেনি, শুধু সেসব আবেদনই অনলাইনে গ্রহণযোগ্য। এ সীমার বাইরে থাকা রিফান্ড আবেদনগুলো সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল করেছে। একই সঙ্গে পূর্বের সব ম্যানুয়াল চেকও মাঠ পর্যায়ের দপ্তর থেকে ফেরত নেওয়া হয়েছে। ফলে বহু প্রতিষ্ঠানের পুরোনো রিফান্ড আবেদন কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৭১১টি আবেদনের বিপরীতে ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার বেশি রিফান্ড আটকে আছে, যা বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য বড় আর্থিক চাপ তৈরি করেছে।
বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, যথাযথ প্রস্তুতি ও সিস্টেম আপগ্রেড ছাড়াই অনলাইন রিফান্ড চালু করায় পুরো প্রক্রিয়ায় একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। সিস্টেমের অকার্যকারিতা, বারবার ত্রুটি দেখানো এবং আবেদন জমা নিয়ে জটিলতার কারণে তারা ভ্যাট পরিশোধ করেও রিফান্ড পাচ্ছেন না। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ও এনবিআর পরস্পরের ওপর দায় চাপাচ্ছে, ফলে সমস্যার স্পষ্ট সমাধানও মিলছে না।
ভ্যাট পরামর্শকদের মতে, নতুন পরিপত্রে যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে তার অনেকটাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংরক্ষণ করা কঠিন। অনলাইনে যুক্ত করা ২৪টি শর্তের চেকলিস্টের কিছু নথি বহু প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। পরিস্থিতি এমন যে—বড়, বহুজাতিক ও অত্যন্ত কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের পক্ষে আবেদন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাদের অভিযোগ, আইন বা প্রজ্ঞাপন সাধারণত ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা নিয়ে জারি হয়, কিন্তু ১০ নভেম্বরের পরিপত্রে ‘ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা’ তৈরি হয়েছে, যেখানে অতীতের আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও নতুন নিয়ম প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ভ্যাট কনসালটেন্ট অব বাংলাদেশের সভাপতি হাসানুল ইসলাম টিপু বলেছেন, আইভাস সিস্টেম আপগ্রেড না করেই আবেদন গ্রহণ শুরু করায় রিফান্ড প্রক্রিয়া এখন আরও জটিল। সিস্টেম বেশির ভাগ সময় ডাউন থাকে, আর যেসব দলিলাদি সংযুক্ত করার শর্ত দেওয়া হয়েছে—তা অনেক প্রতিষ্ঠানেরই কাছে নেই। এতে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর রিফান্ড প্রাপ্তির পথ আরও সংকুচিত হচ্ছে। তিনি মনে করেন, অনলাইন ও ম্যানুয়াল আবেদন অন্তত একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সমান্তরালভাবে চালু রাখলে ব্যবসায়ীরা এমন ভোগান্তিতে পড়তেন না। তাছাড়া এনবিআর আটটি খাতে রিফান্ডের বিধান থাকলেও আপাতত শুধুমাত্র আগাম কর রিফান্ড দিচ্ছে, ফলে বাকি খাতগুলোর রিফান্ড ঝুলে থাকার কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকুচিত হয়ে বাজারে পণ্যমূল্যেও চাপ বাড়ছে।
অন্যদিকে এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন কোনো কাগজপত্র চাওয়া হয়নি—আগেও এসব জমা দেওয়ার নিয়ম ছিল, তবে মাঠ পর্যায়ে তা কঠোরভাবে যাচাই করা হতো না। অনলাইন প্রক্রিয়া কেবল স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্যই চালু করা হয়েছে, যাতে রিফান্ড অনুমোদনের পর অর্থ সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। এনবিআরের সদস্য সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান, একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ আবেদন জমা পড়ায় সিস্টেমে সাময়িক চাপ তৈরি হয়েছে। সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলছে এবং ডকুমেন্ট আপলোড সুবিধা পুরোপুরি কার্যকর হলে পুরোনো রিফান্ড আবেদনও ধাপে ধাপে সিস্টেমে যুক্ত করা হবে। তার দাবি, কাগজপত্রের পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়েনি—যা আগে ম্যানুয়ালভাবে জমা দিতে হতো, এখন তা অনলাইনেই জমা দিতে হচ্ছে।
ডিজিটাল রিফান্ড চালু করার মূল লক্ষ্য ছিল স্বচ্ছতা ও দ্রুত সেবা প্রদান। কিন্তু প্রস্তুতিহীনতা, সিস্টেম দুর্বলতা এবং কঠোর শর্ত আরোপ—সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের জন্য রিফান্ড পাওয়ার পথ আগের চেয়েও জটিল হয়ে উঠেছে। ফলাফল—মূলধন আটকে যাওয়ায় বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বাজারে সামগ্রিক মূল্যধারার ওপর সরাসরি চাপ তৈরি হচ্ছে। ●
অকা/রা/ই/সকাল/৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 hours আগে

