অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভিত্তি ও শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে পরিচিত টেক্সটাইল খাত বর্তমানে এক গভীর অস্তিত্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গত তিন দশকে দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই শিল্প এখন উৎপাদন ব্যয়, নীতিগত দুর্বলতা এবং বৈষম্যমূলক প্রতিযোগিতার চাপে টিকে থাকার লড়াই করছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে স্থানীয় বাজারে সুতা বিক্রিতে ১০ শতাংশ বিশেষ ক্যাশ সহায়তা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। সংগঠনটির সতর্কবার্তা—এই সহায়তা এবং আমদানিতে সেফগার্ড শুল্ক আরোপ না হলে দেশের টেক্সটাইল শিল্প ধসের মুখে পড়তে পারে।

বিটিএমএ জানায়, সংকটের তীব্রতায় ইতোমধ্যেই দেশের ৫৮টি স্পিনিং ও ডাইং মিল আংশিক বা পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে এক লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, যা শিল্পখাতের পাশাপাশি সামগ্রিক শ্রমবাজারের জন্যও বড় ধাক্কা। যেসব মিল এখনো সচল রয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। অনেক কারখানায় উৎপাদিত সুতা বিক্রি না হওয়ায় গুদাম ভরে গেছে, ফলে লোকসানে হলেও পণ্য ছাড়তে হচ্ছে। পরিস্থিতির চাপে বেশ কয়েকটি মিল উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে এবং নতুন বিনিয়োগের চিন্তা আপাতত স্থগিত রেখেছে।

এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে উৎপাদন ব্যয়ের দ্রুত বৃদ্ধি। বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল জানান, ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশে পৌঁছানো, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম একাধিক দফায় বাড়ানো এবং টাকার অবমূল্যায়নের সম্মিলিত প্রভাবে টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন খরচ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এই অতিরিক্ত ব্যয় স্থানীয় মিলগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে তো বটেই, এমনকি নিজস্ব বাজারেও প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।

একই সময়ে প্রতিবেশী ভারত তাদের টেক্সটাইল খাতে ব্যাপক ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদকদের শক্তিশালী করছে। এর ফলে ভারতীয় সুতা বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে প্রবেশ করছে, যা অনেক ক্ষেত্রে ডাম্পিংয়ের অভিযোগকে জোরালো করছে। বিগত এক বছরে ভারত থেকে সুতা আমদানি প্রায় ৪৮ শতাংশ বেড়ে যাওয়াকে দেশীয় শিল্পের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

সংকট মোকাবিলায় বিটিএমএ ইতোমধ্যে বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে একাধিক দফা বৈঠক করেছে। সংগঠনটি আগামী পাঁচ বছরের জন্য স্থানীয় বাজারে সুতা বিক্রিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে দেশীয় মিল থেকে অন্তত ৫০ শতাংশ সুতা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের যুক্তি, এতে একদিকে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্প টিকে থাকবে, অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাতের সরবরাহ চেইন আরও শক্তিশালী হবে।

এ ছাড়া বন্ড সুবিধায় আমদানি করা সুতা ও কাপড় যেন খোলা বাজারে বিক্রি না হয়, সে জন্য কঠোর নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। বিটিএমএ’র আশঙ্কা, বর্তমান নীতিগত সহায়তা ও বাজার সুরক্ষা না পেলে ২০২৬ সালের মধ্যেই অর্ধেকের বেশি টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সংগঠনটির তথ্যমতে, বর্তমানে এই খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান জড়িয়ে আছে। দেশের নিট পোশাক শিল্পের প্রায় শতভাগ এবং ওভেন পোশাক শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ সুতার চাহিদা স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো থেকেই পূরণ হয়। ফলে এই খাত দুর্বল হয়ে পড়লে তৈরি পোশাক শিল্পের পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাই মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। এমন বাস্তবতায়, বিপুল বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রক্ষায় সরকারের দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।
অকা/তৈপোশি/ই/সকাল/২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে

Leave A Reply

Exit mobile version