অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশের শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের অস্থিরতা ও আস্থার গভীর সংকট ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৫ সালেই ৬৬ হাজার ৫১৪টি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার) অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি শেয়ারশূন্য হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, এসব বিনিয়োগকারী তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে কার্যত বাজার থেকে সরে গেছেন।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ধারাবাহিক সূচক পতন, বাজার মূলধনের উল্লেখযোগ্য সংকোচন এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়িয়ে শেয়ার বাজার ত্যাগ করছেন। এতে করে দীর্ঘমেয়াদে বাজারের গভীরতা ও তারল্য—দু’টিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সিডিবিএল-এর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় বর্তমানে মোট বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমে ৪২ হাজার ৭৮৯টি হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৩৯ হাজারে। এই পতন কেবল কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরুষ বিনিয়োগকারীদের বিও অ্যাকাউন্ট কমেছে ২৭ হাজার ৮৮৪টি, নারী বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১৫ হাজার ২৪টি। পাশাপাশি অনিবাসী বাংলাদেশি (এনআরবি) বিনিয়োগকারীদের বিও অ্যাকাউন্টও কমেছে ৩ হাজার ১৪৪টি। বাজার সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই চিত্র পুরো শেয়ারবাজার ব্যবস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক অনাস্থারই প্রতিফলন।
আরও উদ্বেগজনক হলো, বর্তমানে সচল হিসেবে বিবেচিত ১৬ লাখ ৩৯ হাজার বিও অ্যাকাউন্টের একটি বড় অংশেই কোনো শেয়ার নেই। প্রায় ৩ লাখ ৬৭ হাজার বিও অ্যাকাউন্ট এখন জিরো ব্যালেন্স বা শূন্য শেয়ার নিয়ে সক্রিয় রয়েছে। অর্থাৎ, অনেক বিনিয়োগকারী প্রশাসনিকভাবে অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করলেও বাস্তবে তারা বাজারে কোনো বিনিয়োগ রাখছেন না। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত অর্থে নিয়মিত লেনদেন করেন এমন সক্রিয় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৪ থেকে ৫ লাখের বেশি নয়।
পতনের পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে একটি কাঠামোগত সংকটের চিত্র স্পষ্ট হয়। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে মানসম্পন্ন নতুন আইপিওর ঘাটতি, ব্যাংক খাতের একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় শেয়ার দরের চাপ এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে দুর্বল করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাজারের সামগ্রিক অস্থিরতা। চলতি ২০২৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৩৩৩ পয়েন্ট। একই সময়ে বাজার মূলধন নেমে এসেছে ৭ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকায়।
একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিনিয়োগ সাধারণত সেখানে প্রবাহিত হয় যেখানে ঝুঁকি তুলনামূলক নিয়ন্ত্রিত এবং মুনাফার সম্ভাবনা স্পষ্ট। তাঁর ভাষায়, “বর্তমান শেয়ারবাজার সেই নিরাপত্তা দিতে পারছে না। সরকারের পরিবর্তনের পর বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের সংস্কারের আশা করলেও বাস্তবে বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।”
শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে মিউচুয়াল ফান্ড ও মার্জিন ঋণের নীতিমালা চূড়ান্ত করা, বিও অ্যাকাউন্টের মেইনটেন্যান্স ফি কমানোর মতো কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপ এখনো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাঁদের মতে, বাজারে মানসম্পন্ন শেয়ারের জোগান বাড়ানো, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা না গেলে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের নিরাপদ ও আকর্ষণীয় মাধ্যম হিসেবে শেয়ার বাজারের গ্রহণযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করা কঠিনই থেকে যাবে। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 days আগে

