দীপক মজুমদার ● চাঁদপুর
ইলিশের ভরা মৌসুম এখন। লোকে বলে ইলিশের বাড়ী চাঁদপুর। ভ্রমণ এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী। শরীর সুস্থ্য রাখতে হাঁটা বা ভ্রমণের কোন বিকল্প নেই।
যান্ত্রিক নাগরিক জীবনের একঘেঁয়েমি দূর করবেন কিভাবে? ঢাকা থেকে কম সময়ে কিছুটা সময় বেড়ানোর কথা যদি ভাবেন, তাহলে বেছে নিতে পারেন ঢাকার কাছেই চাঁদপুরকে। সড়ক, রেল এবং জলপথে সব পথেই ইলিশের বাড়ী চাঁদপুরে যাওয়া যায়। তবে জলপথে ভ্রমণ আনন্দদায়ক। নদী পথে আড়াই ঘন্টা থেকে ৩ ঘন্টায় চাঁদপুর যাওয়া যায়। আবার দিনেই ফিরে আসা যায়। সারা সময়ই লঞ্চ ও স্টীমার ঢাকা–চাঁদপুর পথে চলাচল করে। মাত্র ৫০০ টাকায় একদিনেই চাঁদপুর ভ্রমণ করতে পারবেন আপনি।
আসুন, আমরা নদী পথে ভ্রমণের আধুনিক শহর চাঁদপুর ঘুরে আসি। পুরানো ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত সদরঘাট গিয়ে ১০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়ুন লঞ্চ টার্মিনালে। ঢুকেই দেখবেন সারি সারি লঞ্চ। টার্মিনালে ঢুকে গন্তব্য অনুযায়ী লঞ্চ খুঁজে বের করাই আপনার প্রথম কাজ।
চাঁদপুরের লঞ্চগুলো মূলত লালকুঠি ৩ নম্বর ঘাটের কাছ থেকে ছাড়ে। যা কি না সদরঘাটের টার্মিনালের পূর্বদিকে অবস্থিত। ৩০ মিনিট পরপর লঞ্চ। তবে এই লঞ্চ ছাড়া সময়ের বিষয়ে তারা কিন্তু বেশ কড়া। আর তাই টুপ করে উঠে পড়ুন।
একদম ঘড়ির কাটা ধরেই লঞ্চ ছেড়ে দেয়। ইট পাথরের জাদুর শহর ঢাকাকে ফেলে রেখে এবার বুড়িগঙ্গার দূষিত বাতাস খেতে খেতে ছুটে চলেছে আপনার জলযান। পথ তুলনামূলক অল্প হলেও এই রুটের লঞ্চগুলো বেশ ভাল মানের ও বড় আকারের।
লঞ্চ ভাড়া
ডেক টিকেট- ১০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি (নন এসি চেয়ার) লঞ্চভেদে ১৩০-১৫০ টাকা, প্রথম শ্রেণি (এসি ইকোনোমিক চেয়ার) লঞ্চভেদে ২২০-২৫০ টাকা, বিজনেস ক্লাস (এসি বিজনেস চেয়ার) লঞ্চভেদে ২৭০-৩০০ টাকা।
সিঙ্গেল কেবিন (নন এসি) ৪০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন (এসি) ৪৫০-৫০০ টাকা, ডাবল কেবিন (নন এসি) ৮০০ টাকা, ডাবল কেবিন (এসি) ৯০০ টাকা, ভি আই পি কেবিন (সিঙ্গেল) ১০০০ টাকা, ভি আই পি কেবিন (ডাবল) ২০০০ টাকা।
লঞ্চেই আছে টুকটাক খাবারের ব্যবস্থা। আড্ডা দিতে দিতে কম সময়ের মধ্যেই চলে যাবেন ইলিশের বাড়ী খ্যাত চাঁদপুরে। শীতলক্ষ্যা থেকে মেঘনা হয়ে, মুন্সিগঞ্জ, মোহনপুর পেছনে ফেলে এক সময় চাঁদপুর পৌঁছে যাবেন।
পুরাতন ঘাটে লঞ্চ ভিড়ে না এখন। পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমস্থল থেকে একটু পেছনে, বাম দিকে নতুন ঘাট। ভেঁপু বাজিয়ে চাঁদপুরের সেই ঘাটেই ভিড়ে লঞ্চ। বড় ঘন্টার আওয়াজও আছে। ইলিশের স্বাদে বুঁদ হওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সারাদিনের ভ্রমণ হিসেবে চাঁদপুর বেশ জনপ্রিয়। বেশিরভাগ পর্যটকরাই একদিনের ট্রিপে চাঁদপুর যান।
লঞ্চ থেকে নেমেই ৭-৮ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। গন্তব্য এবার বড় স্টেশন। পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনটি বড় স্টেশন নামে খ্যাত। সামনে গেলেই মোহনা। এ স্থানটি দেখার জন্যও ভ্রমণ পিপাসুরা চাঁদপুরে ঘুরতে যান। এখানে বড় বড় পাথরে নদী বাঁধ দিয়ে আটকানো। প্রতিদিন বাঁধের ওপর হাজার হাজার মানুষ বসে। এখানে নদী ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে বেড়াতে আসে। ভীড় করা মানুষ আড্ডা-গল্পে মশগুল হয়ে ওঠেন বড় স্টেশনের ‘ঠোডায়’। এর ঠিক সামনেই পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া তিন নদীর মোহনা।
শহরের প্রাণকেন্দ্র স্টেডিয়াম রোডে লেকের মাঝখানে ‘রক্তধারা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ এখানে জ্বলজ্বল করছে। চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে, ভেতরে আগে রিকশা বা অটো প্রবেশ করে বিশৃংখল অবস্থা তৈরি করতো বলেই এই ব্যবস্থা। রক্তধারা’ স্মৃতিস্তম্ভটি খুব সুন্দর। গায়ে লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
ইলিশ ছাড়া দুপুরের খাবার ঠিক যেন জমে না! বড় স্টেশন ছাড়াও শহরে উন্নত মানের খাবার হোটেলে পাবেন ইলিশের নানা পদের সুস্বাদু খাবার। আর স্টেশনের সঙ্গেই লাগোয়া পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন হোটেলতো আছেই।
গরম ভাত, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা, ইলিশের মাথা দিয়ে লাউয়ের চচ্চুড়ি এবং নানা রকমের ভর্তা দিয়ে তৃপ্তি সহকারে দুপুরের খাবার সারতে পারেন। ইলিশের বাড়ী চাঁদপুরেই তৈরি হয় বিখ্যাত এ আইসক্রীম। এর নাম ‘ওয়ান মিনিট আইসক্রীম’। শুধু আইসক্রীম নয়, এখানকার মিষ্টিও চমৎকার এবং সুস্বাদু।
চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র কালীবাড়ী এলাকা সংলগ্ন প্রেসক্লাব সড়কে ‘ওয়ান মিনিট’ নামের মিষ্টান্ন বিপনীর অবস্থান। ১৯৬৩ সালের দিকে পূর্ব পুরুষের হাত ধরে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি স্বগৌরবে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতি কাপ আইসক্রিমের দাম ৪০ টাকা। মতলবের ক্ষীর ও হাজীগঞ্জের ঘিগজ ধানের মুড়ি ও রসালো মিষ্টি আখ দেশ বিখ্যাত।
পুরোনো বড় স্টেশন হয়ে নদী পেরিয়ে মিনি কক্সবাজার যেতে পারেন। আপনার হাতে সময় থাকলে ঘুরতে যেতে পারেন চাঁদপুরের মিনি কক্সবাজার খ্যাত হাইমচর থেকে।
শুকনো মৌসুমে পানি কমে গেলে হাইমচরের বিশাল এলাকা জেগে ওঠে। বড় স্টেশনের কাছ থেকে ট্রলারে জনপ্রতি ৮০-১০০ টাকা ভাড়ায় ঘুরে আসতে পারবেন এই চর থেকে। তবে যদি আপনার বড় গ্রুপ হয় তবে মাত্র ৬০০ টাকাতেও ৯-১০ জন ঘুরে আসতে পারেন রিজার্ভ ভাড়া নিয়ে।
চরে নেমে সময় কাটাতে পারেন। খুবই অল্প গভীর পানির এই স্থানে। চাঁদপুর জেলায় রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত একটি। চাঁদপুর ত্রিনদীর সঙ্গমস্থল বড় স্টেশন মোলহেড থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পদ্মা ও মেঘনার মিলনস্থলের দক্ষিণ পূর্ব অংশে বালুময় ভূমি এটি।
নদীপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উঁচু হওয়ায় শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমের ভরা জোয়ারেও এটির পুরো অংশ পানিতে ভেসে যায় না। বছর জুড়ে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে এখানে। মূলত ২০১৮ সালের শুরুর দিকে এটি পরিচিতি লাভ করে মিনি কক্সবাজার হিসেবে।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে দেশব্যাপী মানুষের কাছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু চাঁদপুরের স্থানটি। নদীর ভাঙা গড়ার মধ্যেই প্রাকৃতিকভাবে স্থানটির উৎপত্তি। প্রতিদিন হাজারও মানুষ ছুটে আসেন এখানে। অসাধারণ এক জায়গা এমনি কক্সবাজার খ্যাত চাঁদপুরের হাইমচর।
যদি আপনার হাতে সময় থাকে, তবে রাত্রি যাপন করতেও পারেন সপরিবারে। কম খরচে বেশ বিলাসবহুল ভালো আবাসিক অনেক হোটেল রয়েছে।
- রাতে থাকার ব্যবস্থা
- জেলা পরিষদ, ডাক বাংলো, হাইমচর, চাঁদপুর
- জেলা পরিষদ ডাক বাংলো, শাহরাস্তি উপজেলা পরিষদের সম্মুখ, শাহরাস্তি, চাঁদপুর ০১৭৩৫২২৮০৪৪
- ভাই ভাই আবাসিক হোটেল; তালতলা বাসস্টেশন, উপজেলা : চাঁদপুর সদর, জেলা: চাঁদপুর
- হোটেল সকিনা ঠিকানাঃ নতুনবাজার, উপজেলা: চাঁদপুর সদর, জেলা: চাঁদপুর
- হোটেল শরীয়তপুর, কোট স্টেশন, চাঁদপুর
- তাজমহল হোটেল, চৌধুরী ঘাট, চাঁদপুর
- হোটেল অতিথি ঠিকানাঃ ম্যাটারনিটি রোড, চাঁদপুর সদর
- উপজেলা ডাক বাংলো, মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ, চাঁদপুর। ০১৮৪৯৮০৫৩৯৫
- হোটেল ষ্টার, হাজীগঞ্জ বাজার বড়পুল এর পূর্ব দক্ষিণ পাশ্বে হাজীগঞ্জ, চাদপুর। ০১৭১৩২১১২৯৯
- হোটেল রেডিসন, গাজী টাওয়ার হাজীগঞ্জ মধ্য বাজার বড় মসজিদের পশ্চিম পাশ্বে হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর
- উপজেলা ডাকবাংলো, মতলব উত্তর
- ডাকবাংলো, ফরিদগঞ্জ
- এছাড়াও অনেক ভালো মানের আবাসিক হোটেল শহরে রয়েছে।
দেশের শিক্ষিত জেলা শহর চাঁদপুরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান যেমন -ফরিদগঞ্জের চান্দ্রা মানিকরাজ রাজাদের নিদর্শন, হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ, শাহরাস্তি মেহের কালীবাড়ী, শহরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউটের পুকুরে উৎপাদিত ইলিশ ইত্যাদিও। এসব দেখে আপনার মন ভরে যাবে আনন্দে।
#
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 years আগে
