অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

চলতি ২০২৫-২৬ কর বছরে দেশের আয়কর প্রশাসনে ডিজিটাল রূপান্তরের গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে ১০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিল করেছেন, যা বাংলাদেশের কর ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার এক সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর জানায়, এ বছরের ৪ আগস্ট অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। তার পর থেকে করদাতারা এনবিআরের ওয়েবসাইটে লগইন করে নিজস্ব প্রোফাইল তৈরি করে কয়েকটি ধাপে আয়, ব্যয় ও সম্পদের বিবরণ পূরণ করে নিমিষেই রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন—যেখানে কোনো কাগজপত্র আপলোডের প্রয়োজন নেই।

বাধ্যতামূলক ই-রিটার্ন: কর প্রশাসনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ

২০২৫-২৬ কর বছরে এনবিআর এক বিশেষ আদেশ জারি করে উল্লেখযোগ্য সংস্কার এনেছে। এখন থেকে ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব প্রবীণ করদাতা, শারীরিকভাবে অক্ষম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি, মৃত করদাতার আইনগত প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক ছাড়া সব ব্যক্তি করদাতার জন্য ই-রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে যাদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা বা সিস্টেম-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল সম্ভব নয়, তারা আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে উপ-কর কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করলে অতিরিক্ত বা যুগ্ম কর কমিশনারের অনুমোদনক্রমে কাগজভিত্তিক (পেপার) রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।

বিদেশে অবস্থানরত করদাতারাও অনলাইনে সংযুক্ত

প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ই-রিটার্ন সিস্টেমে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। এখন তারা এনবিআরের নির্ধারিত ইমেইলে তাদের পাসপোর্ট নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইমেইল ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য পাঠালে ইমেইল মারফত একটি ওটিপি (One-Time Password) ও নিবন্ধন লিংক পান। এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত করদাতারাও রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে নিজের নামে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারেন—বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাকে বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত করার এটি একটি বাস্তব পদক্ষেপ।

সহজ ইন্টারফেস ও স্বয়ংক্রিয় স্লিপ সিস্টেম

ই-রিটার্ন সিস্টেমে করদাতাকে শুধুমাত্র তার প্রকৃত আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের তথ্য এন্ট্রি করতে হয়। সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর নির্ধারণ করে দেয় এবং দাখিল শেষে করদাতা সঙ্গে সঙ্গে ই-রিটার্ন স্লিপ ডাউনলোড করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি ডিজিটাল হওয়ায় দাখিল থেকে প্রাপ্তির মধ্যে সময় ও প্রশাসনিক জটিলতা দুই-ই উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

সেবা ও প্রশিক্ষণে এনবিআরের প্রস্তুতি

করদাতাদের অনলাইন রিটার্নে দক্ষতা বাড়াতে এনবিআর গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সারা দেশের কর অঞ্চলে স্থাপিত ই-রিটার্ন হেল্প ডেস্কগুলোতে অফিস চলাকালীন সময়ে করদাতারা ফ্রি সহায়তা পাচ্ছেন।
এছাড়া, এনবিআর স্থাপন করেছে একটি কেন্দ্রীয় কল সেন্টার (০৯৬৪৩ ৭১ ৭১ ৭১)—যেখান থেকে করদাতারা তাৎক্ষণিক ফোনকলের মাধ্যমে ই-রিটার্ন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর বা প্রযুক্তিগত সহায়তা পাচ্ছেন।

ডিজিটাল কর প্রশাসনে নতুন দিগন্ত

বিশ্লেষকদের মতে, ই-রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার ফলে করদাতার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা বাড়ছে, এবং রাজস্ব সংগ্রহ আরও দক্ষভাবে তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি, স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের কারণে কর নির্ধারণে মানবিক ভুল বা প্রভাবের সুযোগও কমে এসেছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ বছর ই-রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ১৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা কর সংস্কৃতিতে নাগরিক সচেতনতা ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসনের প্রতি আস্থার প্রতিফলন। বাংলাদেশের কর প্রশাসন এখন স্পষ্টভাবে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। এনবিআরের ই-রিটার্ন উদ্যোগ শুধু কর আদায় সহজ করেনি, বরং করদাতাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ককেও আরও স্বচ্ছ, সময়োপযোগী ও প্রযুক্তিবান্ধব করে তুলেছে।
অকা/রা/ই/সকাল/২ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 17 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version