অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বর্তমান সময়ে শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীরা একের পর এক ধাক্কার মুখে পড়ছেন। ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কাটতে না কাটতেই নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে, যা বাজারে ভয়, অনিশ্চয়তা ও আস্থার ঘাটতি আরও তীব্র করেছে।
প্রথম ধাক্কা আসে পাঁচটি দুর্বল শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত হওয়ার ঘোষণায়। এতে শেয়ারহোল্ডারদের প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মূল্য এক দিনে উবে যেতে থাকে। বাজার তখনো পুরোপুরি স্থির হতে না হতেই আরেকটি বড় সংকট দেখা দেয়—মোট ৯টি এনবিএফআই, যার মধ্যে ৮টি তালিকাভুক্ত, অবসায়নের প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে। এতে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের আরও প্রায় ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে।
এই দুই আঘাত মিলিয়ে শেয়ার বাজারে গত সোমবার ব্যাপক বিক্রির চাপ তৈরি হয়। ঢাকা শেয়ার বাজারে লেনদেন হওয়া প্রায় ৮৩ শতাংশ শেয়ারদর কমে যায়। এনবিএফআই খাতে পতন ছিল আরও বেশি—শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসে, কারণ আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা হাতে থাকা শেয়ার দ্রুত বিক্রি করতে শুরু করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক অবসায়নের তালিকায় এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে রেখেছে। ঘোষণার পরদিনই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফারইস্ট, জিএসপি, বিআইএফসি, এফএএস ও পিপলস লিজিংের শেয়ারদর ৮ শতাংশের বেশি কমে যায়, প্রাইম ফাইন্যান্স ৫ শতাংশ এবং প্রিমিয়ার লিজিং ৩ শতাংশ হারায়।
ডিএসইর মূল সূচক ডিএসইএক্স টানা চাপের মুখে গত দুই সপ্তাহে প্রায় ৪০০ পয়েন্ট হারিয়ে প্রথমবারের মতো ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে আসে। এরপর সামান্য ঘুরে দাঁড়ালেও এনবিএফআই অবসায়নের নতুন ধাক্কায় সূচক আবার ৪ হাজার ৯১৪ পয়েন্টে নেমে যায়।
অবসায়নের তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশ বহু বছর ধরেই গভীর ঋণাত্মক নেট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) নিয়ে চলছে। তালিকাভুক্ত ৮টির মধ্যে ৭টির গড় এনএভি শেয়ারপ্রতি ঋণাত্মক প্রায় ৯৫ টাকা। অর্থাৎ তাদের দায় তাদের সম্পদের তুলনায় এত বেশি যে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো মূল্য অবশিষ্ট থাকার সম্ভাবনা নেই। কেবল প্রাইম ফাইন্যান্স ২০২৩ সালে শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা ৩১ পয়সা ধনাত্মক এনএভি দেখাতে পেরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে—গত বছর শেষে এনবিএফআই খাতের মোট ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের ৫২ শতাংশই এই আটটি প্রতিষ্ঠানের দখলে। পুরো খাতের মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠান মিলে বহন করছে খেলাপি ঋণের ৭৩.৫ শতাংশ। অর্থাৎ সংকটটি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিরই বহিঃপ্রকাশ।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আর্থিক বিবরণীতে প্রকৃত ঝুঁকির চিত্র বহু বছর ধরে প্রতিফলিত হয়নি। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার কারণে ছোট বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত অবস্থার ধারণা পাননি। তাদের মতে, বহু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুরবস্থা “জম্বি অবস্থায়” রূপ নিলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০টি এনবিএফআইকে ‘রেড ক্যাটাগরি’ হিসেবে চিহ্নিত করে লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলে ৯টি প্রতিষ্ঠান সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হয়—যেগুলোই এখন অবসায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
এই বাস্তবতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে। তাদের উদ্বেগ এখন আর বাজার লাভ নয়—বরং নিজেদের মূলধন রক্ষা করা। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/২ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে

