অর্থকাগজ প্রতিবেদন

দেশে দারিদ্র্যের হার গত তিন বছরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে তা দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে। একই সময়ে অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য প্রকাশ করে পিপিআরসি। ‘ইকনোমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণায় মে মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন ব্যক্তির মতামত নেওয়া হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, শহর ও গ্রামে আয়-ব্যয়ের মধ্যে একটি বৈষম্য তৈরি হয়েছে। শহরে পরিবারের গড় আয় কমেছে, অথচ খরচ বেড়েছে। বর্তমানে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা হলেও ব্যয় হচ্ছে ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। অথচ ২০২২ সালে শহরের পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। অন্যদিকে গ্রামে পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। বর্তমানে গ্রামের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ২৯ হাজার ২০৫ টাকা এবং ব্যয় ২৭ হাজার ১৬২ টাকা, যেখানে ২০২২ সালে গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। অর্থাৎ শহরের পরিবারের আয় হ্রাস পেলেও গ্রামের পরিবারের আয় তুলনামূলকভাবে বেড়েছে, তবে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যয় বৃদ্ধি স্থায়ী চাপ তৈরি করছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির পেছনে মূলত মুদ্রাস্ফীতি, আয়ের অসম বণ্টন এবং কর্মসংস্থানের স্থবিরতা দায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, শহরে আয় কমে যাওয়া এবং খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তে নেমে যাচ্ছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সাবেক পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির কারণে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও শিল্প ও সেবা খাতে মন্দাভাব শহুরে পরিবারের সংকটকে বাড়িয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি বাজারদর ও খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে গ্রামীণ আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিও টিকবে না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মন্তব্য করেন, অতি দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। এই জনগোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাদের জন্য পুনর্বাসন ও টেকসই সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত না করা গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে এবং অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে। গ্রামীণ ও শহুরে পরিবারের আয়-বৈষম্য বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে সামাজিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনও বেড়ে যেতে পারে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের মতে, খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ, শহরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং আয়-বৈষম্য কমাতে নীতিগত সংস্কার জরুরি। অন্যথায় দারিদ্র্যের হার আগামীতে আরও বেড়ে দেশের উন্নয়নযাত্রাকে ব্যাহত করবে।
অকা/প্র/ই/সকাল/২৬ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 3 weeks আগে

Leave A Reply

Exit mobile version