অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

টানা দরপতনের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না দেশের শেয়ার বাজার। চলতি সপ্তাহের তিন কার্যদিবসেই বাজারের প্রধান সূচক নিম্নমুখী থাকায় বিনিয়োগকারীদের হতাশা আরও গভীর হয়েছে। সূচক কমার পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে তলানির দিকে নেমে এসেছে। এই স্থবিরতার মধ্যেও একটি বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে—চলতি ডিসেম্বর মাসে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে একই সময়ে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া বাজারের জন্য স্পষ্টতই উদ্বেগজনক বার্তা বহন করছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে আস্থাহীনতায় ভুগছে শেয়ারবাজার। গত দেড় দশকে একের পর এক অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্বল নজরদারির কারণে অসংখ্য বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর ফল হিসেবে বাজার থেকে ধীরে ধীরে সরে গেছেন বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা। তবে সামনে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাংশ বিনিয়োগকারীর মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে—রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটলে হয়তো বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। এই প্রত্যাশা থেকেই স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ নতুন করে বিও হিসাব খুলছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শেয়ার বাজারে লেনদেনের জন্য বিও হিসাব অপরিহার্য। কোনো বিনিয়োগকারী ব্রোকারেজ হাউজ বা মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে এই হিসাব খুলে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন। বিও হিসাবের সার্বিক তথ্য সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বর মাসে এখন পর্যন্ত প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ১৫৯টি নতুন বিও হিসাব খোলা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বিও হিসাব বাড়লেও বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে বিপরীত প্রবণতা স্পষ্ট।

এ প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাজারে মন্দাভাব বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কিছু সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তব প্রতিফলন এখনো বাজারে দেখা যাচ্ছে না। তাঁর মতে, আস্থার সংকট কাটেনি বলেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ধারাবাহিকভাবে বাজার ছাড়ছেন। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় বিও হিসাব বাড়লেও সেখান থেকে প্রকৃত অর্থে কতটা বিনিয়োগ আসছে, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। কারণ বাজারে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।

সিডিবিএলের তথ্য বলছে, চলতি মাসের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ার বাজারে মোট বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭২১টিতে, যা ১ ডিসেম্বর ছিল ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৯৬৯টি। অর্থাৎ ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে মোট ১ হাজার ৭৫২টি বিও হিসাব বেড়েছে। এই সময়ে ১১টি কার্যদিবস পার হওয়ায় দৈনিক গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১৫৯টি। তবে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব কমেছে। বর্তমানে তাদের নামে বিও হিসাব রয়েছে ৪৩ হাজার ৫৪৫টি, যেখানে মাসের শুরুতে ছিল ৪৩ হাজার ৫৫৯টি—অর্থাৎ কমেছে ১৪টি। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই প্রবণতা নতুন নয়। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকেই বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে বাজার ছাড়তে শুরু করেন। ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তাদের নামে বিও হিসাব ছিল ৫৫ হাজার ৫১২টি। সেই হিসাবে এক বছরেরও কম সময়ে কমেছে প্রায় ১১ হাজার ৯৬৭টি বিও হিসাব।

অন্যদিকে, স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ সামান্য হলেও বেড়েছে। বর্তমানে দেশি বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব রয়েছে ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪০৪টি, যা ১ ডিসেম্বর ছিল ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬২টি। অর্থাৎ চলতি মাসে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব বেড়েছে ১ হাজার ৭৪২টি। তবে দীর্ঘমেয়াদি চিত্র মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। গত দুই বছরে শেয়ারবাজারে বিও হিসাব কমেছে এক লাখের বেশি। ২০২৪ সালের শুরুতে যেখানে মোট বিও হিসাব ছিল ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৫৫১টি, সেখানে বর্তমানে তা নেমে এসেছে ১৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭২১টিতে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩০টি বিও হিসাব।

লেনদেনের চিত্রও বাজারের দুর্বলতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। গতকাল ঢাকা ও চট্টগ্রাম—উভয় স্টক এক্সচেঞ্জেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে মাত্র ৪৮টির দর বেড়েছে, বিপরীতে ২৯৯টির দর কমেছে। এতে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৩৬ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৮৫৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। পাশাপাশি শরিয়াহ সূচক ও ডিএসই-৩০ সূচকও নিম্নমুখী রয়েছে। লেনদেনের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়, যা আগের কার্যদিবসের তুলনায় প্রায় ৩৭ কোটি টাকা কম।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) একই চিত্র। সেখানে লেনদেন হওয়া ১৬০টি কোম্পানির মধ্যে ১০৩টির দর কমেছে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই কমেছে ৭৬ পয়েন্ট। লেনদেন হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা বাজারের স্থবিরতারই প্রতিফলন।

সব মিলিয়ে, সূচক ও লেনদেনের দুর্বলতা, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ধারাবাহিক প্রস্থান এবং দীর্ঘমেয়াদি আস্থার সংকট—এই তিনটি চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে মোকাবিলা না করতে পারলে শেয়ারবাজারের টেকসই ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 10 hours আগে

Leave A Reply

Exit mobile version