এম এ ইউসুফ খান ●
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় সাতশ কোটি মানুষের প্রায় সাড়ে তিন শ‘ কোটিই নারী। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও বৈশ্বিক অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। আবার অনেক দেশের নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি কাজ করেন। কিন্তু নারীর কাজের স্বীকৃতি যেমন কম, তেমনি কাজের বিনিময়ে মজুরি বা পারিশ্রমিকের পরিমাণও পুরুষদের তুলনায় কম। অথচ নারী যদি কাজের ক্ষেত্রে উপযুক্ত মজুরি পেত তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে আরো বেশি করে পড়ত, এমনকি তার নিজের পরিবারেও এর প্রভাব পড়ত। ফলে সামগ্রিকভাবে পরিবারের সচ্ছলতা বেড়ে যেতো। বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় একজনের উপার্জনে সংসার চালানো খুবই কষ্টদায়ক। সেক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর কাজের সঠিক মূল্যায়ন হলে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বেড়ে যেতো। নারী-পুরুষের সমতা একদিকে যেমন অর্থনীতিকে গতিশীল করে, অন্যদিকে তেমনি দেশের বৃদ্ধি করে।
বিশ্ব ব্যাংকের এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে শ্রমশক্তির ৪৩ শতাংশই নারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অর্ধেকেরও বেশি নারী। গত ৩০ বছরে প্রায় ৫০ কোটি নারী বিশ্বকর্মপ্রবাহে সামিল হয়েছেন। নারী ও পুরুষ লিঙ্গের সম অধিকারকে এখন আর খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কাজেই নারীদের সাফল্যের জন্য দক্ষতা অর্জনে বাধা দেয়া ও উপার্জন করতে না দেয়াটা শুধু মস্ত বড় ভুলই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর।
পৃথিবীর মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে আমেরিকায়। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রেই নারীর প্রাধান্য। ১৮ বছর বয়স হলেই ছেলে মেয়ে পিতা-মাতার ওপর নির্ভর না করে নিজের উপার্জনে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করে থাকে। ওই দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে হাইস্কুলের গ-ি পার হতে না হতেই স্বাধীনভাবে চলার লক্ষ্যে তাকে উপার্জনে ঢুকতে হয়। ফলে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ডের বিল, গাড়ির পেমেন্ট, ইউটিলিটি ও হেলথ ইন্স্যুরেন্সের বিল বিশেষ করে গার্ল ফ্রেন্ডেন পেছনে খরচ অর্থাৎ জীবন এক গতানুগতিক গোলাকার বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায়। আমেরিকায় পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। চারপাশে তাকালেই যেনো নারী আর নারী। সবাই ব্যস্ত। শুধু কাজ আর কাজ। প্রতিটি কাজেই নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। বড় বড় বাস-ট্রামগুলোর চালকের আসনে বসে যখন নারীরা রাজপথে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ড্র্রাইভ করেন তখন মনে হয় গাড়িগুলো যেন তাদের হাতের পুতুল, তাদের সে নিয়ন্ত্রণ দেখার মতো।
আমেরিকা গোটা বিশ্বের কাছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃত। তারাই বিশ্বের একমাত্র গর্বিত মুরুব্বি এবং উপদেশদাতা। নারীদের চাকরি-বাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত উদার। নারীদের স্বাধীনতায় তারা কখনো হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু নারীদের একটি ব্যাপারে তারা ভিন্নমত পোষণ করেন, তাহলো রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে আমেরিকায় নীতি-নির্ধারকরা বল সব সময় নিজেদের কোর্টেই রাখেন। নারীদের কোর্টে বল পাঠান না। তারা মনে করেন, গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীরা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবে না। আমেরিকা অনেক সমতার দেশ হলেও এক্ষেত্রে অসমতার দেশ। তারা অন্য দেশকে শুধু উপদেশই দেয় না, প্রয়োজনে চোখ রাঙায়। কিন্তু নিজেরা বাস্তবায়ন বা প্রতিপালন করে না। নিজেদের দেশে এটি একটি অলিখিত নারী-পুরুষ বৈষম্য। এ অসমতা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু নীতি-নির্ধারকরা নির্বিকার। আলোচনা-সমালোচনা কোনটাই তারা পরোয়া করে না। আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ক্ষেত্রটি শতভাগ পুরুষ শাসিত। অর্থাৎ পুরুষ নারীদের শাসন করছে। আরেরিকাকে আমরা যতই ‘ল্যান্ড অব অপরচুনিটি’ বলি না কেন নারীদের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। কর্পোরেট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আবম্ভ করে সরকারি প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে নারীদের অবস্থান অতি নগণ্য। যত শিক্ষাগত যোগ্যতাই থাকুক না কেন নারী নারীই, তার সীমা নির্ধারিত।
যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের মহান বাণীকে দেশে দেশে পৌঁছিয়ে দিতে তৎপর। কিন্তু তাদের সেই মহান গণতন্ত্রের দেশে আজ পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট জায়গা করে নিতে পারেনি। এমনই মহান গণতন্ত্রের দেশে দুটি বড় রাজনৈতিক দল যথাক্রমে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান ছাড়া তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দলও গড়ে উঠেনি। হিলারি ক্লিনটন ডেমোক্র্যাট দল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লক্ষ্যে মনোনয়ন দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু মার্কিন পুরুষেরা একজন নারীকে তাদের নেতা হিসেবে মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি বলে হিলারিকে শেষ পর্যন্ত মনোয়ন দেয়নি। মনোনয়ন পেয়েছিলেন বারাক ওবামা।
অপরদিকে নারী নেতৃত্বে বাংলাদেশ কিন্তু মোটেই পিছিয়ে নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশের নারী সমাজ নিজের পরিচয়ে ইতোমধ্যে ক্রমে ক্রমে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী যেখানে নারী সেখানে তাদেরকে বাইরে রেখে শিল্পোন্নত হওয়া, সমৃদ্ধি অর্জন করা যে সম্ভব নয় তা বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পেরেছেন। নারী স্বাধীনতা হচ্ছে একটি স্বাধীন দেশের নারীদের স্বাধীনভাবে নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ভাগ্য গড়ার সুযোগ-সুবিধা। নারী স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা বা বাকপটুতা নয়।
আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দুই নারী নেত্রী থাকলেও তাদের উদাসীনতার জন্য নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকে যতটুকু নজর দেয়া উচিৎ ছিল তা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে এক এক করে নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত করছে। ভাঙছে শক্ত প্রাচীর, বের হয়ে আসছে অন্ধকার থেকে আলোয়। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশেই এখন নারীরা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সম্প্রতি বহুল প্রচারিত মার্কিন কীতো “টাইম” বিশ্বের প্রভাবশালী ১২ জন নারী রাষ্ট্র প্রধানের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে শীর্ষে রয়েছেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা। তালিকায় থাকা নারীদের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তালিকায় অন্যান্য সরকার প্রধানগণ হচ্ছেনÑ জার্মান চ্যন্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ দা কার্শনার, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফ, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট অ্যালেন জনসন সিরলিফ, আইসল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট জোহানা সিগুরদারদোত্তির, কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট ল্যঁরা চিনচিলা, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট তারজা হ্যালোনেন, লিথুনিয়ার প্রেসিডেন্ট দালিয়া গ্রেবাউসকাইতে এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী কমলাপ্রসাদ বিশ্বেশ্বর।
#
লেখক সাবেক ব্যাংকার ও নিয়মিত লেখক
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 years আগে
