বিপ্লব মোহন্ত
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত ‘তালগাছ’ কবিতায় লিখেছেন “তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে”। এর মাধ্যমে তাল গাছ অন্য সব গাছ থেকে অনেক লম্বা তাই হয়তো কবি বুঝাতে চেয়েছেন। তাল গাছ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি বহুবর্ষজীবি উদ্ভিদ। এটি এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলের গাছ। এই গাছের ফলকে তাল বলা হয়। এরা এরিকাসি পরিবারের বরাসুস গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এটি অনেক লম্বা একটি গাছ যার উচ্চতা ৩০ মিটার বা ১০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। তালের পাতা পাখার মত ছড়ানো থাকে। এর প্রায় সব অঙ্গ থেকেই কিছু না কিছু কাজের জিনিস তৈরী হয়, প্রায় কিছুই ফেলা যায় না। তাল পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, পুতুল ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরী হয়। বাড়ি, নৌকা, হাউস বোট ইত্যাদি তৈরীতেও তালের কাণ্ড ব্যবহৃত হয় । কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ তাল পাতায় তাদের লেখার কাজ চালাতেন। পুরাতন অনেক পুঁথি সাহিত্য, চিত্র ইত্যাদি তালপাতায় রচিত হয়েছে। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছে তালপাতায় রচিত পুস্তিকা।
তালের ফল এবং বীজ দুইই খাওয়া যায়। তালের ফলের ঘন নির্যাস থেকে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু তাল পিঠা তৈরী হয়। কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থাতেই তালের বীজ খাওয়া হয়। কচি তালের বীজের মধ্যে থাকে জলে ভরা শাঁস। আর পাকা তালের বীজ রেখে দিলে বীজ মধ্যস্থ শাঁস তালের আঁটিতে পরিণত হয়। তাল গাছের কাণ্ড থেকেও রস সংগ্রহ হয় এবং তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি ইত্যাদি তৈরি হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তালে রয়েছে ভিটামিন এ ২০৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৩৫.১ মিলিগ্রাম, জিংক ০.২৭ মিলিগ্রাম, আয়রন ১.৭ মিলিগ্রাম ও ক্যালসিয়াম ১৬ মিলিগ্রাম সহ আরো অনেক খনিজ উপাদান ( কৃষি ডায়েরী ২০২৫)। এর সাথে আরো আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান। একথা বলা যায় তাল উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ একটি ফল।
আমাদের দেশে প্রতি বছর বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর আমাদের দেশে গড়ে প্রায় ৩০০ জন লোক বজ্রপাতে মারা যায়। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এপ্রিল-জুন মাস পর্য়ন্ত সময়ে সাধারণত বজ্রপাত বেশী হয়। এ সময়ে মাঠে পুরোদমে বোরো ধান কর্তন শুরু হয়। তাই ফাঁকা মাঠে কর্মরত কৃষি শ্রমিকেরা বজ্রপাতের ঘটনায় সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয়। মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয় বজ্রপাত। পতিত হয় ভূমিতে, কেড়ে নেয় প্রাণ। বজ্রপাতের সময় তাপমাত্রা কয়েক মাইক্রেসেকেন্ডের জন্য হতে পারে প্রায় ৩০০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্টের তাপমাত্রার চেয়েও বেশী। তাল গাছ বা অন্য কোন উঁচু গাছ থাকলে প্রথমেই বজ্রপাত সেই গাছের উপড় পড়বে এবং সরাসরি মাটিতে আঘাত করার সম্ভাবনা কমে যাবে। তাই প্রানহানীর ঘটনা এড়াতে উঁচু গাছ বিশেষ করে তাল গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ২৬২৭১১১ টি তাল গাছ রয়েছে। দেশে সবচেয়ে কম সুনামগঞ্জ জেলায় ১২৬৫ টি তাল গাছ আছে। জেলা ত্রাণ ও দুযোগ ব্যবস্থাপনা কাযালয় হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নওগাঁ জেলায় ২০২২ সালে ১৭ জন, ২০২৩ সালে ৮ জন, ২০২৪ সালে ৭জন এবং চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩ জন সহ মোট ৩৫ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। এ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলায় গত ৪ বছরে মাত্র ১ জন নিহত হয়েছেন। জেলাতে মোট তাল গাছের সংখ্যা ২৯৪৬৬০ টি এবং জেলার সবচেয়ে বেশী তাল গাছ আছে নিয়ামতপুর উপজেলায়। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর এলাকা বেষ্টিত। এ জেলায় তালগাছের সংখ্যা ৮৫০০ টি। হাওর বেষ্টিত উপজেলাগুলির মধ্যে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও করিমগঞ্জ অন্যতম। এই এলাকাগুলিতে গাছের সংখ্যা অনেক কম, বিশেষ করে তাল গাছ নেই বললেই চলে। জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কিশোরগঞ্জ জেলায় ২০২২ সালে ১০ জন, ২০২৩ সালে ১৫ জন, ২০২৪ সালে ৭ জন এবং চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১৭ জন সহ মোট ৪৯ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। জেলায় ১৩ টি উপজেলা রয়েছে। এর মধ্যে হাওর বেষ্টিত উপজেলায় মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন। একক ভাবে করিমগঞ্জে মোট ১০ জন, যেখানে ২০০০০ হেক্টর জমি অধ্যুষিত চামটা হাওর অবস্থিত। এসব উপাত্ত থেকে বলা যায় যেসব জায়গাতে তাল গাছ কম আছে, সেখানে বজ্রপাতে হতাহতের পরিমাণ অনেক বেশী। এসব স্থানগুলিতে বিস্তীর্ণ এলাকার ফাঁকা জায়গায় লোকজন কাজ করে। বজ্রপাতের সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে না পারায় এসব জীবন সংহারী দুর্ঘটনা ঘটে।
খরা এবং জলাবদ্ধতা সহ্যকারী এ গাছ পানি ছাড়াই দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে। আবার গাছের গোড়ায় পানি দাঁড়ালেও সহজে মারা যায় না। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য প্রকৃতির এক অনন্য উপহার তালগাছ । বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ যেমন: তীব্র খরা, মাটির নিচে থাকা পানিস্তরের নীচে নেমে যাওয়া, শৈত্যপ্রবাহ, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ। সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে ঠায় একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তালগাছ। পাখিরাও তা জানে। তাই পাখিরা তাদের বসবাসের জায়গা বানায় তালগাছকে। বাবুই পাখির বাসা তালগাছে, বাদুড় থাকে তালগাছে, শকুন ও ঈগল আশ্রয় নেয় তালগাছে। সারা দিন মাঠে চরে বেড়ানো ময়ূরও নাকি রাতে ঘুমায় তালগাছের মাথায়। টিয়া পাখি ডিম পাড়ে তালগাছের ওপরে। এ জন্য কোনো কোনো দেশে তালগাছকে মনে করা হয় শক্তির প্রতীক হিসেবে। কম্বোডিয়ার জাতীয় বৃক্ষ তালগাছ।
আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে তাল, খেঁজুর, গোলপাতা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। যে রস থেকে আমরা চিনি বা গুড়ের অভাব পূরণ করতে পারি। তালের রস উৎপাদনের পরিমাণ খেজুরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। পুরুষ তাল গাছ থেকে গ্রীষ্মকালে ৩-৪ মাস রস সংগ্রহ করা যায়। পুরুষ তাল গাছের লম্বা পুষ্পমঞ্জুরী বের হয়। এই পুষ্পমঞ্জুরীকে চট বা শক্ত কাপড় দিয়ে ৬-৭ দিন ভালো করে ঘঁষে নরম করতে হয়। তারপর পুষ্পমঞ্জুরীর আবরণ তুলে মাথা কেটে পুষ্পমঞ্জুরিগুলিকে মাটির কলসিতে ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এই মাটির কলসিতে ফোটায় ফোটায় রস পড়ে। স্ত্রী তাল গাছ থেকেও রস আহরণ করা হয়। স্ত্রী তাল গাছের পুষ্পমঞ্জুরি বের হওয়ার ১০-১২ দিন পর কাঠের দণ্ড দ্বারা কয়েক দিন পুষ্পমঞ্জুরিকে পিটিয়ে হালকাভাবে থেতলে দিতে হয়। এরপর পুষ্পমঞ্জুরির মাথা কেটে মাটির কলস ঝুলিয়ে দিলে ফোটায় ফোটায় রস পড়ে। একটি তাল গাছ থেকে বছরে প্রায় ৪০০-৫০০ লিটার রস উৎপন্ন হয়। তা থেকে ৬০-৭০ কেজি গুড় পাওয়া সম্ভব। গাছের বয়স, মাটি, আবহাওয়া এবং পরিচর্যার উপর রসের গুণগতমান ও পরিমাণ নির্ভর করে। যশোর জেলাসহ কিছু এলাকায় গ্রীষ্মকালে নিয়মিত তাল রস বিক্রয় হয়। অনেক লোক এই রস পান করে। ফরিদপুর জেলায় বাণিজ্যিকভাবে তালের রস থেকে গুড় উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও নওগাঁ, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরিয়তপুর সহ কিছু জেলায় তাল গুড় উৎপাদিত হয়। ফরিদপুরসহ কিছু এলাকায় তালের রস থেকে তালমিছরি তৈরী করা হয়। দেশে যে পরিমাণ তাল গাছ আছে তার ২৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৬৫০০০০ তাল গাছ থেকে বছরে ৪০০০০ টন গুড় উৎপাদন করা সম্ভব।
বৃক্ষখেকোদের আগ্রাসনে বাংলাদেশের জীব বৈচিত্রের সাথে সাথে প্রাকৃতিক বৈচিত্রও ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু তাল গাছ কমে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালগাছের পরিকল্পিত রোপণের মাধ্যমে সাজাই প্রকৃতি। সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অন্তত একটি তাল গাছ রোপণে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে সারা দেশে গড়ে উঠবে বজ্ররোধী সবুজ বেষ্টনী। বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য আমাদের বেশী করে তাল গাছ রোপণ করতে হবে। কয়েক বছর ধরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তালের বীজ এবং চারা রোপণের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাল গাছের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে চলতি বছর প্রনোদনা কর্মসূচীর মাধ্যমে সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১০০০০০ তাল চারা রোপণ করা হয়েছে। তাল গাছের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যা গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখবে। প্রকৃতিতে তাল গাছের অবদান, পুষ্টিমান নিয়ে সম্প্রসারণবিদদের জনসচেতনা তৈরীর মাধ্যমে এ কর্মসূচীকে সফল করা সম্ভব হতে পারে।
লেখক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর কর্মকর্তা
অকা/নিলে/কৃখা/ই/বিকেল/২৫ আগস্ট/২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 2 months আগে

Leave A Reply

Exit mobile version