অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশের পুঁজি বাজারে একসময় কারসাজি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার দিয়ে বাজারে দাপট দেখানো হতো, আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পড়তেন ভয়াবহ ক্ষতির মুখে। শেয়ার দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হতো নিয়মিতভাবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাজারের চিত্র পাল্টেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর নজরদারি, কোম্পানি যাচাই-বাছাইয়ে কঠোরতা এবং লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে নেওয়া উদ্যোগের ফলে বাজারে নতুন আস্থার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কারসাজি নির্ভর কোম্পানির যুগ শেষ হতে চলেছে। এর জায়গায় শক্তিশালী মৌলভিত্তির কোম্পানিই বাজারের নেতৃত্ব দেবে। এর বাস্তব প্রমাণ মিলছে সাম্প্রতিক লেনদেনের পরিসংখ্যানে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ কার্যদিবসে শীর্ষ ১০ লেনদেনের মধ্যে অন্তত আটটি কোম্পানি শক্তিশালী মৌলভিত্তির। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি) সর্বোচ্চ ৩৫ কোটি ৬০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করেছে। দ্বিতীয় স্থানে সিটি ব্যাংক, যার লেনদেন ৩৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এরপর ব্র্যাক ব্যাংক ৩৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করেছে। এছাড়া তালিকায় রয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, বেক্সিমকো ফার্মা, উত্তরা ব্যাংক ও গ্রামীণফোনের মতো কোম্পানি।
এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয় যে, বিনিয়োগকারীরা আবারও ফিরে আসছেন সেইসব প্রতিষ্ঠানে, যাদের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও মুনাফার ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মানসিকতাতেও পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে মুখে মুখে শোনা গুজবের ওপর নির্ভর করে শেয়ার কেনাবেচা হতো, এখন বিনিয়োগকারীরা তথ্য যাচাই করছেন। এক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী রাকিব হোসেন বলেন, “অনেকবার স্পেকুলেটিভ শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আমি কেবল মৌলভিত্তি শক্তিশালী কোম্পানির শেয়ার কিনি। স্কয়ার ফার্মা ও রেনেটার মতো কোম্পানিগুলো আমার পোর্টফোলিওতে ভালো রিটার্ন দিচ্ছে।”
বাজারের এই পরিবর্তনের পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জ যৌথভাবে লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের যে কার্যক্রম শুরু করেছে, তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনর্গঠনে সহায়ক হচ্ছে। বিএসইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এখন বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। অযথা প্রচারণা নয়, সঠিক তথ্য পরিবেশন ও মান যাচাইয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে।”
অন্যদিকে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও বাজারকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝেও রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থিতিশীল আছে। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই প্রেক্ষাপট পুঁজি বাজারে আস্থার সংকট কাটাতে সহায়ক হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি এড়িয়ে মৌলভিত্তি শক্তিশালী কোম্পানির দিকে ঝুঁকছেন। গ্রামীণফোন, বিএটিবিসি, স্কয়ার ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, রেনেটা, ওয়ালটন, বার্জার পেইন্টস, লিনডে বিডি, বিএসআরএম, কনফিডেন্স সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, মবিল যমুনা লুব্রিক্যান্টস, পম্মা ও যমুনা অয়েলের মতো শেয়ার বর্তমানে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাজারের এই পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী নয়, বরং কাঠামোগত। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর অবস্থান ও বিনিয়োগকারীর সচেতনতা মিলিয়ে ভবিষ্যতের পুঁজি বাজারে মৌলভিত্তির শেয়ারই স্থিতিশীলতার মূল চালিকাশক্তি হবে। ●
অকা/পুঁবা/ই/সকাল/২৪ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 months আগে

