প্রণব মজুমদার ●
উন্নয়নের অব্যাহত যাত্রায় দেশ। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সংযোগ প্রদান সরকারের চলমান কার্যক্রম। দেশের সকল মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ থাকবে এমনটা স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ণ করে যেতে পারেনিনি তিনি। স্বপ্ন কার্যকরণের সেই ধারাবাহিকতায় দেশের অধিকাংশ জনগণ বিদ্যুতের আওতায় চলে এসেছে। পিতার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ণের লক্ষ্যে কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাজ করে চলেছেন। তাঁর সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদেই দেশ গঠনে স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলে জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটির ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
বঙ্গবন্ধু গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের অভিপ্রায়ে বলেছিলেন, বিদ্যুৎ ছাড়া কোন কাজ হয় না, কিন্তু দেশে জনসংখ্যার ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থল গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। এর ফলে গ্রামবাংলার সর্বত্র উন্নতি হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করতে পারলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হতে খাদ্য আমদানি করতে হবে না’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জুলাই, ১৯৭৫)। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী এ ভাবনার ধারাবাহিকতায় পল্লী জনগণের দোরগোড়ায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানোর লক্ষ্যে পরে এবং পর্যায়ক্রমে পল্লী বিদ্যুৎতায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎতায়ন বোর্ডের আওতায় ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (পবিস) সমগ্র বাংলাদেশে বিদ্যুতায়ন কাজে নিয়োজিত আছে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) আওতায় দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ৭৫০০ মেগাওয়াট, যা দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৫৫ শতাংশ। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বিআরইবির দেয়া উপাত্তে দেখা যায় ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ২ হাজার ৮৫২ কিলোমিটার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২ হাজার ৭১৩ কিলোমিটার লাইন বিতরণ করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তা প্রায় ১২ গুণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় বিতরণ লাইনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হাজার কিলোমিটার, বিতরণ করা হয় ৩৩ হাজার ৭৪৩। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বিদ্যুৎ প্রাপ্ত হন ৪ লাখ ৬১ হাজার ৪১৭ জন গ্রাহক। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহক সংযোগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ২ হাজার ১১ জনে।
উল্লেখিত হিসাবের মধ্যে ১ লাখ ৯২ হাজার শিল্প সংযোগ ও ৩ লাখ ৫৪ হাজার সেচ সংযোগ, ১ লাখ ৫৫ হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ১৩ হাজার ৮৫০ পাওয়ারলুম, ১০ হাজার ৪৩৯ হাঁস-মুরগির খামার, ৫ হাজার ৬৬৬ মৎস্য খামার, ১ হাজার ২২৪ দুগ্ধ খামারে সংযোগ রয়েছে। সিস্টেম লস কমেছে। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে সিস্টেম লস ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক প্রকল্প নির্মানাধীন রয়েছে। নির্মাণাধীন প্রকল্প এবং সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উপাদনের পরিমাণ হলো মোট ৪৮টি প্রকল্পে ১৬ হাজার ৮৭৫ মেগাওয়াট। এরমধ্রে বেসরকারি খাতে ৩০টি প্রকল্পে ৭ হাজার ৬৩ মেগাওয়াট, সরকারি ১৮টি প্রকল্পে ৯ হাজার ৮১২ মেগাওয়াট। এ উপাত্ত বিদ্যুৎ বিভাগের। বিদ্যুৎ উপদানে সরকারের ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে দেশের ১০০ শতাংশ মানুষ। গেল বছর পর্যন্ত
৯৬ শতাংশ মানুষ এ সুবিধাভুক্ত হয়েছে। এ সময় দেশে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৫১০ ঘঃ কিলোওয়াট। ২০২০ সালে দেশব্যাপী বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। চলতি বছর চাহিদা ১৯ হাজার মেগাওয়াট। জনগণের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে ভারত, ভূটান ও নেপাল থেকে আমদানি হচ্ছে।
প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারীরা আলোর ফেরিওয়ালা সেজে সেজে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ৫ মিনিটে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করছে। গ্রামে গ্রামে এবং পাড়ায় পাড়ায় গ্রাহকের আঙ্গিনায় উঠা বৈঠক করছে। বিগত ৬ বছরের এক হিসেবে দেখা গেছে, দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা ধরে প্রতি মিনিটে প্রায় ২৭ জন নতুন গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। এজন্য প্রতি মিনিটে নতুন বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ০.৫ কিমি, যা দেশের জন্য একটি নজিরবিহীন ঘটনা। শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় ৪৬১টি উপজেলার মধ্যে ইতোমধ্যে ২৮৮টি উপজেলা প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। অবশিষ্ট ১৭৩টি উপজেলা উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাহাত্তরের সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রীর কালজয়ী উদ্যোগ ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ কর্মসূচী এখন সফল বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। শুধু গ্রীড এলাকার (স্থায়ী জমিতে) মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এখন চলছে অফগ্রীড এলাকা তথা নদী বিধৌত চরাঞ্চলে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে গ্রীড লাইন সম্প্রসারণের কাজ। ইতোমধ্যে দেশের সমগ্র চরাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৫৯ গ্রামে বৈদ্যুতিক লাইন ও সাবস্টেশন নির্মাণ করে সংযোগ দেয়ার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এ কাজ শেষ হলে আরও প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আসবে। সার্বিকভাবে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ। আর এজন্য নিয়োজিত আছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। আরও আছে উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠানসহ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও কর্মচারী।
শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ বিষয়ক উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও বিভিন্ন সময় দায়িত্বরত সচিববৃন্দের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, অকুণ্ঠ সমর্থন ও অব্যাহত সহযোগিতা এ পথকে করেছে প্রশস্ত এবং গতিশীল। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের নেতৃত্বে বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবঃ) মঈন উদ্দিনের দূরদর্শী ও ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগে তৈরি হয়েছে অনেক কর্মপন্থা! যেমন- আলোর ফেরিওয়ালা, দুুর্যোগে আলোর গেরিলা, উঠান বৈঠক প্রভৃতির মাধ্যমে সম্পৃক্ত করা হয়েছে দেশের বহু শ্রেণির পেশা ও মিডিয়াকে। ফলে দালাল ও দুর্নীতিবাজদের সমূলে উচ্ছেদ করে শতভাগ বিদ্যুতায়নে কার্যকর উদ্ভাবনী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়েছে।
ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ কর্মসুচির সফল বাস্তবায়নের পথ ধরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এখন অনলাইনে সংযুক্ত হতে পারছে। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর বিকাশ, রকেট, টেলিটক, শিউর ক্যাশ, এম ক্যাশ ইত্যদির মাধ্যমে মানুষ বিদ্যুৎ বিল প্রদানসহ নানামুখী আর্থিক লেনদেন করছে। ঘরে বসেই দেশের ছেলেমেয়েরা অনলাইনে পড়াশোনা করছে। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এমনকি করোনা দুর্যোগেও থেমে নেই বাংলদেশের অর্থনীতির চাকা। থেমে নেই কৃষকের খাদ্য উৎপাদন ও শিল্প-কারখানা। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের আর এক সাফল্য ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গেই মাত্র ৩ মাসের মধ্যে ছিটমহলবাসীকে চির অন্ধকার থেকে আলোকিত জনপদ উপহার দেয়া হয়েছে। মিয়ানমার থেকে বিতারিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করে তাদের মানবেতর জীবনকে কিছুটা হলেও লাঘব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৯৮টি প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ হাজার পরিবারকে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। দুস্থ মানুষের সেবায় নিয়োজিত ১৫ হাজার ৫০০টি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্য সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ গড়ঃযবৎ ড়ভ ঐঁসধহরঃু খেতাবে ভূষিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ প্রায় ৭০ হাজার গৃহহীন মানুষকে ঘর প্রদানের মাধ্যমে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেই জনগণকে দ্রুতগতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করে দুঃখী জীবনের ঘরে আলো জ্বালানো হচ্ছে। এখানেও ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো!
আজ দেশের আনাচে কানাচে জলে স্থলে সবখানে ১৭ কোটি জনগণের বাংলাদেশ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত যা নিঃসন্দেহে আনন্দের। নিঃসন্দেহে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াবার এক অনন্য সূচক। যার প্রভাব ঘটছে দেশ অর্থনীতির জিডিপিতে।
২০০৯ সালের আগে বিদ্যুতের অভাবে দেশের অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর, শিল্প বাণিজ্য ছিল স্থবির এবং জনজীবনে লোড শেডিং ছিল অসহনীয়। তা এখন তেমন একটা নেই বলা যায়। এই দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ কর্মসূচীর ইতিবাচক প্রতিফলন।
#
লেখক গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি ও সাংবাদিক
writerpranabmajumder@gmail.com
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 years আগে

