অর্থকাগজ প্রতিবেদন
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প (আরএমজি) বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে দেশের বাজারে বিভিন্ন জ্বালানি উপকরণের দাম বাড়ানো, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দামে ব্যাপক ওঠানামা। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে বিদেশি ক্রেতাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনামের মুক্তবাণিজ্য চুক্তিও দেশের পোশাকশিল্পে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের পোশাক রপ্তানির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি পর্যায়ে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আসছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কারণে কিছু দেশে পোশাক রফতানিতে শুল্ক ও কোটা সুবিধা পাওয়া যায়। এ তালিকা থেকে বের হলে ওইসব সুবিধা আর মিলবে না। তখন উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা করে পোশাক রফতানি করতে হবে। তখন বাংলাদেশকে আরও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান করতে হবে। এজন্য বাণিজ্য খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার অঙ্গীকার করতে হবে। এর মধ্যে কিছু খাতে রফতানি ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে। বিনিয়োগনীতিতে সমন্বয়, মেধা সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার নীতি জোরদার করতে হবে।

রফতানির প্রবৃদ্ধিনির্ভর করছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও এখন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের উচ্চ সুদের হার, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং একটি জটিল আর্থিক পরিবেশ রপ্তানি খাতের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশাগুলোকে আগামীতে আরও কিছুটা সঙ্কুচিত করে দিতে পারে।

সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবর থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ওই সময় থেকে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এতে তৈরি পোশাকশিল্পের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে পণ্য রফতানি করতে বাড়তি সময় লাগছে। যা ক্রেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এ কারণে অনেক ক্রেতা রফতানির নতুন আদেশ দেওয়া কমিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমই্এ) পক্ষ থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বৈশ্বিক মন্দা ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ইতোমধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ব্যবসা হারিয়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরও খারাপ অবস্থা হবে।

ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি শীতল সম্পর্কের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর দ্বারা ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রভাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রমনীতি প্রয়োগের হুমকি দিয়েছে। এর দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

দেশের মোট পোশাক রফতানির ৮২ শতাংশ যাচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি রফতানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থাৎ ২২ শতাংশ। জার্মানিতে ১৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে সাড়ে ১২ শতাংশ পোশাক রফতানি হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। এখানে রফতানি বাধাগ্রস্ত হলে এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যাবে। যা সামাজিক অস্থিরতাকে উসকে দিতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।

এছাড়া অর্থনৈতিক খাতের চ্যালেঞ্জগুলোও বাড়ছে। দেশে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। রফতানি ঋণের সুদ ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে। কারণ এ তহবিলের আকার ৭০০ কোটি ডলার থেকে কমিয়ে ৪০০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর আকার আরও কমানো হচ্ছে। বৈশ্বিকভাবে সুদ বাড়ায় ও রিজার্ভ সংকটের কারণে বিদেশি ঋণ গ্রহণের সুযোগও সঙ্কুচিত হয়েছে। যে কারণে বিদেশি ঋণের প্রবাহও কমেছে। বৈশ্বিকভাবে সুদ ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সব মিলে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকশিল্পের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম। দেশটির সঙ্গে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে ভিয়েতনাম ইউরোপে পোশাক রফতানিতে বিশেষ সুবিধা পাবে। যেটি বাংলাদেশ পাবে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে তৈরি পোশাকের রফতানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে আরএমজি সেক্টর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। নারীর ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে। এখন পর্যন্ত এ খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আসছে। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে পোশাকশিল্প খাত ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশের মতো অবদান রেখেছিল। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে মোট রফতানি আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০ শতাংশই আসে পোশাক রফতানি থেকে।

এদিকে প্রতিবছরই পোশাকশিল্পে মূল্য সংযোজনের হার বাড়ছে। ২০২০ সালের জুলাই সেপ্টেম্বরে পোশাক খাতে নিট মূল্য সংযোজন ছিল ৬৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে।

আন্তর্জাতিক বড় ক্রেতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ এখন রফতানির আদেশ বাড়াতে শুরু করেছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ব্র্যান্ডগুলো আবার সক্রিয় হতে শুরু করেছে। এটি দেশের জন্য একটি সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।

এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পোশাক তৈরিতে বৈচিত্র্য আনা, রফতানি আদেশ দেওয়ার পর দ্রুত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ, দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত উৎপাদন ও খরচ কমানো, কার্যকর গবেষণা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করা, রফতানি বাড়াতে নতুন বিশ্ববাজার খুঁজে বের করা, দক্ষ আরএমজি কর্মী বাহিনী এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিকীকরণ অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে আরএমজি রপ্তানি আয়ে বিশ্বে তৈরি পোশাকের রফতানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম থাকতে পারে।

অকা/তৈপোশি/ সকাল/২ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 2 years আগে

Leave A Reply

Exit mobile version