অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বিশ্ববাজারে খেলনা শিল্পের আকার ইতোমধ্যেই ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ১৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস রয়েছে। অথচ রপ্তানি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো বৈশ্বিক বাজারে উল্লেখযোগ্য অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। বর্তমানে দেশের খেলনা শিল্প থেকে বার্ষিক রপ্তানি মাত্র ৭৭ মিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ, যা বৈশ্বিক আকারের তুলনায় নগণ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতিগত সহায়তার ঘাটতি, কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব এবং উদ্ভাবনী নকশা ও গবেষণায় সীমাবদ্ধতা এ খাতের বিকাশে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীতে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ডাইভারসিফাইং দ্য এক্সপোর্ট বাস্কেট: ইনোভেশন, এক্সপোর্ট পটেনশিয়াল অ্যান্ড মার্কেট এক্সপ্যানশন অব দ্য টয় ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক এক ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দিকগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
নীতিগত জটিলতা ও শুল্ক প্রতিবন্ধকতা
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ অনুষ্ঠানে বলেন, "২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খেলনা রপ্তানি বাজারের আকার ১৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, অথচ বাংলাদেশ কেবল সেই বাজারে প্রবেশের শুরু করেছে।" তিনি আন্তর্জাতিক ক্রেতার সীমাবদ্ধতা, টেস্টিং সুবিধার ঘাটতি এবং উচ্চ শুল্ককে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস: পলিসি ও আইসিটি) মুহাম্মদ মুবিনুল কবির বলেন, তৈরি পোশাকের বাইরে রপ্তানি খাত বৈচিত্র্যকরণ অত্যন্ত জরুরি। তিনি জানান, বন্ড সুবিধা সম্প্রসারণ এবং শুল্ক কার্যক্রম সহজীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি খেলনা শিল্পের জন্য নীতিগত সহায়তা আগামী বাজেটে বিবেচনা করা যেতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বৈশ্বিক সম্ভাবনা ও বিদেশি আগ্রহ
ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর মার্টিন ডসন বলেন, বাংলাদেশের তৈরি খেলনার যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় বাজারে ‘ব্যাপক সম্ভাবনা’ রয়েছে। তার মতে, রুলস অব অরিজিন ও কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করা গেলে বাজারে প্রবেশ অনেক সহজ হবে।
শিল্পের পরিসংখ্যান ও চ্যালেঞ্জ
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি ও জলালাবাদ পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমেদ। তার তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ২৫০টি খেলনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন।
তিনি জানান, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খেলনা রপ্তানি মাত্র ১৫.২ মিলিয়ন ডলার হলেও ২০২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ মিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে বাংলাদেশি খেলনা বিশ্বের ৮৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তবে মান নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, দুর্বল নকশা উদ্ভাবন এবং গবেষণার অভাব এ খাতকে পিছিয়ে রাখছে।
উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি
বিভিন্ন উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি আলোচনায় একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
-
রেডমিন ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. জুহিরুল ইসলাম শিমুল উদ্ভাবনী নকশার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
-
হ্যাশি টাইগার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মুসা বিন তারেক কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ককে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
-
গোল্ডেন সন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ অভিযোগ করেন, খেলনা শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট নীতি না থাকায় উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের যুগ্ম প্রধান মো. মামুন-উর-রশিদ আসকারি আমদানি সহজীকরণের জন্য সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেম চালুর প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে মেধাস্বত্ব সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
পরিবেশগত দিক
পরিবেশ অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, পরিবেশবান্ধব বা গ্রিন প্লাস্টিক শিল্পের জন্য কর ছাড় ও বিভিন্ন সুবিধা চালু করা হলে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হবে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টেকসই গবেষণায় যুক্ত করার আহ্বান জানান।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট অধিদপ্তরের পরিচালক অশোক কুমার রায় খেলনা নির্মাতাদের প্রতি আহ্বান জানান, বৈশ্বিক নকশা নকল না করে নিজস্ব পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক গ্রহণ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে—এই প্রেক্ষাপটে স্বকীয়তা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
সামনে এগোনোর পথ
আলোচনায় বক্তারা বলেন, প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার দেশীয় বাজার এবং লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে খেলনা শিল্প। এজন্য আলাদা নীতি প্রণয়ন, আধুনিক পরীক্ষাগার স্থাপন, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং সরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি।
ডিসিসিআই নেতারা অনুষ্ঠানের শেষে আবারও পৃথক নীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনী পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তাদের মতে, এসব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের খেলনা শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে একটি শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক খাতে পরিণত হবে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে