অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বিদেশ থেকে ফেরার সময় পরিচিতদের সবচেয়ে সাধারণ অনুরোধ—“একটা ফোন নিয়ে আসিস”—আসলে বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারের গভীর সমস্যার সরাসরি প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, ভারত বা মালয়েশিয়ায় যে ফোন সহজলভ্য দামে কিনতে পাওয়া যায়, সেই একই মডেলের দাম ঢাকায় গিয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। বৈশ্বিক বাজারের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি দামে ফোন কেনার এই বাস্তবতা এখন বাংলাদেশের ভোক্তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা।
যুক্তরাষ্ট্রে আইফোন-১৭ যেখানে ৭৯৯ ডলার (প্রায় ৯৭ হাজার টাকা), দুবাইয়ে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা, সেখানে ঢাকার অনুমোদিত দোকানগুলোতে একই মডেলের দাম ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার কাছাকাছি। স্যামসাং, ভিভো, শাওমি—সব ব্র্যান্ডেই একই চিত্র। যে দেশে মাথাপিছু আয় তুলনামূলক কম, সেই দেশেই ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনের দাম বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ—এমন এক বৈপরীত্য বাজারকে অচল করে রেখেছে।
এর মূল কারণ চড়া কর কাঠামো। বৈধভাবে আমদানিকৃত ফোনে প্রায় ৫৭–৫৯ শতাংশ সম্মিলিত কর দিতে হয়—ভ্যাট, রেগুলেটরি ডিউটি, অগ্রিম করসহ সব মিলিয়ে, যা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, বৈশ্বিক বাজারেও বিরল। সরকার স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিল, কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীত প্রভাব দেখা দিয়েছে। শিল্প তৈরির পরিবর্তে বাজার অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়েছে, দাম বেড়েছে, আর গ্রে মার্কেট আরও শক্তিশালী হয়েছে।
ফলাফল হলো বৈধ পরিবেশকের ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে। এলসি জটিলতা, অনিশ্চিত সরবরাহ শৃঙ্খল, কমপ্লায়েন্স ব্যয়—সব মিলিয়ে খুচরা বিক্রেতারা বলে থাকেন যে “অনিশ্চয়তা নিজেই এক ধরনের খরচ”, এবং সেই খরচ শেষ পর্যন্ত ভোক্তার উপর এসে পড়ে।
অন্যদিকে গ্রে মার্কেট—বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক বা দেশের জেলা শহরের দোকানগুলো—অবৈধভাবে আমদানি করা ফোন ৩০–৫০ শতাংশ কম দামে বিক্রি করে। কোনো কর নেই, ট্র্যাকিং নেই, অথচ অফিশিয়াল বাজারের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা। ফলে বৈধ ফোনের বিক্রি কমে, অর্থনীতি স্কেল কমে যায়, এবং অফিসিয়াল ফোন আরও দামী হয়ে ওঠে।
বাজারে থাকা ৩২–৩৫ লাখ মাসিক বিক্রির বেশিরভাগই অ্যান্ড্রয়েড ফোন—যেখানে শাওমি, স্যামসাং, ভিভো, অপো, রিয়েলমি ও অন্যান্য ব্র্যান্ড বাজার দখল করে আছে। কিন্তু এসব ব্র্যান্ডের স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল করা মডেলগুলোরও দাম ভারতে বা চীনের চেয়ে অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে ভিভো এক্স-২০০—চীনে ৭৩,৮০০ টাকার ফোন ঢাকায় বিক্রি হয় ১ লাখ ৩৩,৯৯৯ টাকায়। এমনকি স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল করা ফোনেও ১৮–২২ শতাংশ কর থাকে, যা চূড়ান্ত মূল্য বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বব্যাপী কর কাঠামোর দিকে তাকালে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ব্যতিক্রমী। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য স্মার্টফোন আমদানিতে শূন্য শুল্ক নেয়। ভারত জিএসটি ১৮ শতাংশ, চীনে ১০–১৫ শতাংশ, মালয়েশিয়া ০–১০ শতাংশ এবং আমিরাতে মাত্র ৫ শতাংশ ভ্যাট। এই শুল্ক বৈষম্য বাংলাদেশের ফোনের খুচরা দামকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে স্মার্টফোন আর বিলাসপণ্য নয়—ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির প্রধান বাধায় পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে, গ্রে মার্কেটের দাপট স্থানীয় শিল্পকেও ভঙ্গুর করে তুলছে। বাংলাদেশে ১৮টি ম্যানুফ্যাকচারিং বা অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট থাকলেও বেশিরভাগই সক্ষমতার অনেক নিচে চলছে। ওয়ালটন, সিম্ফনি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি—অবৈধ ফোনের দামের সাথে বৈধভাবে উৎপাদিত বা আমদানিকৃত ফোন প্রতিযোগিতা করতে পারে না। যে দামে দুবাই থেকে ব্যাগে করে আনা ফোন বিক্রি হয়, সেই দামে স্থানীয় কারখানা পণ্য বাজারজাত করা অসম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক যৌক্তিক না করা হলে, এনইআইআর চালু হলেও গ্রে মার্কেট সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বরং মূল্যবৈষম্য বজায় থাকলে ভোক্তা আরও বেশি অননুমোদিত চ্যানেলের দিকে ঝুঁকবে।
স্মার্টফোন এখন শিক্ষা, কর্মসংস্থান, আর্থিক লেনদেন ও ডিজিটাল সেবার প্রধান মাধ্যম। তাই উচ্চ কর কেবল বাজারের সমস্যা নয়—এটি জননীতিগত অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধকতাও। নীতিনির্ধারকদের অংশীজনরা এখন শুল্কহার কমানোর বিষয়ে ভাবছেন; তবে বাস্তবে দাম কমার জন্য কেবল কর নয়—অবৈধ আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিশীলতা, এবং স্থানীয় উৎপাদনকে প্রতিযোগিতামূলক করার উদ্যোগ সব মিলিয়ে কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন।
বাংলাদেশে স্মার্টফোনের দাম কেন এত বেশি—এর উত্তর একটাই: কর কাঠামোর বৈষম্য, বাজারের অদক্ষতা এবং গ্রে মার্কেটের দাপটে বৈধ ব্যবসায়ীদের দুর্বল অবস্থা। আর দাম কমবে কি না—তা নির্ভর করছে নীতিগত সংস্কার কত দ্রুত এবং কতটা গভীরভাবে বাস্তবায়িত হয় তার ওপর। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 hours আগে

