আসমা খান
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। চিকিৎসা ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশই ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়, যা সরকারি হিসেবে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে ওষুধের দামের ঊর্ধ্বগতি সরাসরি রোগী ও তাদের পরিবারের আর্থিক চাপে রূপ নিচ্ছে। গত কয়েক মাসে বাজারে বহুল ব্যবহৃত ওষুধের দামে গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, যা সরকারের অনুমোদিত সীমার বাইরে চলে গেছে।
সরকারি নিয়ন্ত্রণ অনুযায়ী মাত্র ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের দাম নির্ধারিত থাকে, যেগুলো বিভিন্ন ব্র‍্যান্ড ও ডোজ ফর্মে প্রায় ৪৬০টি পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে। অথচ দেশে নিবন্ধিত ব্র‍্যান্ডের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। এর মানে হলো, ওষুধের বাজারের বিশাল অংশ কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে কোম্পানিগুলো উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে, কিংবা প্রতিযোগিতার মধ্যে মার্কেটিং খরচ মেটাতে, খুচরা দাম নিজেদের মতো করে বাড়িয়ে দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করেছে, বহু ওষুধে ‘অঘোষিত’ মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে, যা সাধারণ রোগীর ওপর বাড়তি বোঝা তৈরি করছে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের কাঁচামাল নির্ভরতা দামের এই ঊর্ধ্বগতির অন্যতম প্রধান কারণ। বর্তমানে দেশের ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টসের ৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশেষ করে ভারত ও চীন থেকেই আসে বড় অংশ। কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, আমদানির শুল্ক বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ ও লজিস্টিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এর ফলে প্রতিটি ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা ইনজেকশনের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।
যদিও সরকার অচও শিল্প গড়ে তুলতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কর ছাড়ের উদ্যোগ নিয়েছে, বাস্তবে উৎপাদন এখনো সীমিত। স্থানীয় উৎপাদন কার্যকরভাবে শুরু না হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপরই নির্ভরশীল রয়ে গেছে। অর্থাৎ টাকার মান কমলে বা আমদানি ব্যয় বাড়লে সরাসরি তার প্রভাব পড়ে ওষুধের দামে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক বাজেটে ভ্যাট বৃদ্ধিও ওষুধের দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে। আগে ট্রেড ভ্যাট ছিল ২.৪ শতাংশ, যা এখন ৩ শতাংশ করা হয়েছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি লেনদেনে অতিরিক্ত খরচ যোগ হয়ে শেষ পর্যন্ত রোগীর কাঁধেই বোঝা চাপছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পরিবহন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ খরচ একসঙ্গে বেড়ে গেছে।
বাস্তব উদাহরণগুলো প্রমাণ করে দামের অস্বাভাবিক লাফ। যেমন -একটি বহুল ব্যবহৃত ব্যথানাশক ওষুধের দাম কয়েক মাসের মধ্যে ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫০ টাকা হয়েছে, যা প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি। আবার ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের দাম গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ সরকার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছে। ফলে অনুমোদনের বাইরে গিয়ে কার্যত অতিরিক্ত দাম বাড়ানো হচ্ছে।
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে যারা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ বা হৃদরোগ তাদের নিয়মিত ওষুধ কিনতে হয়। মাসে গড়ে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি খরচ করতে হচ্ছে, যা নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য বড় বোঝা। অনেকে ওষুধ কিনতে না পেরে চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে শুধু রোগ জটিল হচ্ছে না, মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।
ধনী শ্রেণি চাইলে দামি ব্র‍্যান্ড ব্যবহার চালিয়ে যেতে পারছে, কিন্তু দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ তুলনামূলক সস্তা বিকল্প খুঁজতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। অনেক রোগী জানেনই না যে একই জেনেরিক নামের সস্তা বিকল্প বাজারে পাওয়া যায়। ফলে তথ্যের অভাব থেকে স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে ইতিমধ্যেই বড় সাফল্য পেয়েছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো ১৫০টির বেশি দেশে ওষুধ রফতানি করছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে এই অস্বাভাবিক দামের বৃদ্ধি যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তবে দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় ভোক্তার আস্থা ক্ষুণœ হবে। এতে অভ্যন্তরীণ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যা শিল্পের ভবিষ্যতের জন্যও ক্ষতিকর।
নীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত শুধু জীবনরক্ষাকারী ওষুধ নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য বহুল ব্যবহৃত ওষুধগুলোকেও নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের মতো অসুখের ওষুধগুলো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন। এগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখলে জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তেই থাকবে।
তাছাড়া ওষুধের দামের বৃদ্ধি আগেভাগে জানানো বাধ্যতামূলক করা দরকার। যাতে ভোক্তারা প্রস্তুত থাকতে পারেন। অনুমোদনবিহীন দামের বৃদ্ধি ঘটালে কোম্পানির বিরুদ্ধে জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল বা সরবরাহে সীমাবদ্ধতার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, দেশীয় অচও উৎপাদনে স্বনির্ভর না হলে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ওষুধ শিল্পকে পূর্ণ সক্ষমতায় আনতে হবে। এজন্য কর ছাড়, নগদ প্রণোদনা, গবেষণা অনুদান ও প্রযুক্তিগত সহায়তা জরুরি।
এছাড়া রোগীদের সচেতনতা বাড়ানোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রোগীদের জানাতে হবে, প্রতিটি ব্র‍্যান্ডের ওষুধের পেছনে আসলেই একই জেনেরিক উপাদান থাকে। বায়োইক্যুইভ্যালেন্স পরীক্ষার তথ্য প্রকাশ করলে রোগীরা বুঝতে পারবেন, সস্তা বিকল্পও সমান কার্যকর। এতে তারা অতিরিক্ত খরচ না করে সাশ্রয়ী দিকটি বেছে নিতে পারবেন।

জাতীয় বাজেটে হ্রাস, বাস্তবে বরং বেশি

ভোক্তা প্রতারণা আমাদের দেশে নতুন নয়। ঋতুমতী নারীদের নিয়মিত ব্যবহার্য সেনিটারী ন্যাপকিনের দাম জুনে ঘোষিত বাজটে কমানো হয়। কিন্তু দোকানগুলোতে এর কোন প্রভাব নেই। বরং আগের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি মূল্যে কিনতে হচ্ছে এসব পণ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে ওষুধের দাম বৃদ্ধি 

ব্যথানাশক - ২৫০ টাকা ৩৫০ টাকা প্রায় ৪০%, ডায়াবেটিসের ওষুধ -৫০০ টাকা ৬২০ টাকা প্রায় ২৪%, হৃদরোগের ওষুধ ৬৫০ টাকা ৮০০ টাকা প্রায় ২৩%, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ১৫০ টাকা ১৯০ টাকা প্রায় ২৬%, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ৪০০ টাকা ৪৯০ টাকা প্রায় ২২% । (উল্লেখিত দামগুলো বাজারে পাওয়া সাধারণ ব্র‍্যান্ডের ভিত্তিতে গড় হিসাবে উপস্থাপিত, সরকারি অনুমোদিত সীমার চেয়েও বেশি বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে।)

বাংলাদেশের ওষুধের বাজারকে যদি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে বেশ কিছু ভিন্নতা চোখে পড়ে।
ভারত - ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ এবং “ফার্মাসি অব দ্য ওয়ার্ল্ড” হিসেবে পরিচিত। ভারতের মোট অচও উৎপাদনের বড় অংশ দেশীয়ভাবে হয়, ফলে তাদের আমদানিনির্ভরতা তুলনামূলক কম। এছাড়া ভারত সরকার ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ এর মাধ্যমে হাজার হাজার ব্র‍্যান্ডের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। দীর্ঘমেয়াদি রোগের ওষুধ যেমন ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের ওষুধের দাম সেখানে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল। ফলে ভারতীয় বাজারে দাম বৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম। তবে গত দুই বছরে ডলারের প্রভাব ও কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বগতি সেখানে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।
শ্রীলঙ্কা - শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের মতোই আমদানিনির্ভর, তবে তারা ওষুধের খুচরা দামের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ চালায়। ‘ন্যাশনাল মেডিসিনস রেগুলেটরি অথরিটি’ সরাসরি অনেক ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয় এবং অনুমোদনবিহীনভাবে দাম বাড়ালে কঠোর শাস্তি দেয়। তাই সেখানে ওষুধের দামে আকস্মিক বৃদ্ধি কম দেখা যায়। তবে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কাতেও কিছু ব্র‍্যান্ড বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়, যার ফলে সাশ্রয়ী বিকল্প সবসময় পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ - বাংলাদেশের তুলনায় ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয় দেশেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলনামূলক শক্তিশালী। বাংলাদেশে যেখানে মাত্র ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেখানে ভারত হাজারো ওষুধকে নিয়ন্ত্রণ তালিকায় রেখেছে। আবার শ্রীলঙ্কায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, যা বাংলাদেশে তুলনামূলক দুর্বল। এ কারণে বাংলাদেশের ভোক্তারা বেশি দামে ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের ওষুধের দাম বৃদ্ধি একক কোনো কারণে ঘটছে না। বরং ডলার সংকট, আমদানিনির্ভরতা, সীমিত মূল্যনিয়ন্ত্রণ, ভ্যাট ও উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি, তদারকির দুর্বলতাÑসব মিলে বহুমাত্রিক সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে- একদিকেওষুধ উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে হবে, অন্যদিকে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
এখন যদি সরকার, শিল্প ও ভোক্তা -তিন পক্ষ সমন্বিত উদ্যোগ না নেয়, তবে এ সমস্যা আরও প্রকট হবে। ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা ব্যাহত হবে এবং স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য গভীরতর হবে।

নকল ওষুধ
নকলে করতে আমরা পারদর্শী। ওষুধের দাম আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কিছু কোম্পানি নকল ওষুধ উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তা বাজারজাত করছে। সারাদেশে ওষুধ বিক্রির শাখা রয়েছে এমন জনপ্রিয় একটি ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্রের মহানগরে অবস্থিত এক শাখা থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ জব্দ করেছে সম্প্রতি। তাদের জরিমানাও করা হয়েছে। সে বিপনীটি এর আগে বেশ কবার এমন গর্হিত কাজের জন্য জরিমানা দণ্ড পেয়েছে। নিয়মিত তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে।

অকা/ওশি/বিপ্র/অপরাহ্ন/ ২৩ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে

Leave A Reply

Exit mobile version