অর্থকাগজ প্রতিবেদন 

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি টানা নিম্নমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৬.২৩ শতাংশে—যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বরের ৬.২৯ শতাংশ থেকেও এটি কম, আর এক বছর আগের ৮.৩০ শতাংশের তুলনায় পতন আরও প্রকট।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা একে নতুন বিনিয়োগের দৃশ্যমান দুর্বলতার সরাসরি প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ও সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রমে আগ্রহ হারিয়েছেন। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যাংকঋণের চাহিদাও স্বাভাবিকভাবেই কমছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, নতুন বিনিয়োগের সংকোচনই ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মূল কারণ। তার ব্যাখ্যা—বিনিয়োগ না বাড়লে যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যায়, ফলে ব্যাংকঋণেরও প্রয়োজন কমে। তিনি উল্লেখ করেন, আগের মতো জালিয়াতির উদ্দেশ্যে নেওয়া ঋণ কমেছে এবং ডলার সংকটও কিছুটা দূর হয়েছে; কিন্তু জ্বালানি সংকট এখন বড় বাধা হয়ে উঠেছে। অনেক কারখানা গ্যাস সরবরাহের ঘাটতিতে উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-অক্টোবর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি প্রায় ৯.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংকিং খাতের তারল্য চাপ ও ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ—যা অনেক ব্যাংকের ঋণ বিতরণ সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমানও একই প্রবণতা তুলে ধরে বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিবেশ বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপযোগী নয়। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমা তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত।

এনআরবিসি ব্যাংকের এমডি মো. তৌহিদুল আলম খান মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চড়া সুদহার ও তারল্য সংকট মিলিয়ে ঋণের চাহিদা ও জোগান—উভয়ই কমে গেছে। তার মতে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তকে আরও ধীর করেছে, ফলে উদ্যোক্তারা অপেক্ষার কৌশল নিচ্ছেন।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট। অনেক বিনিয়োগকারী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। তাদের ধারণা, নির্বাচনের পর নীতি-পরিবেশ স্পষ্ট হতে সময় লাগবে, আর সে পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।

ব্যবসায়ী নেতাদের বক্তব্যও একই সুর ধরে। ডিসিসিআই সভাপতি তাসকিন আহমেদ মনে করেন, বিনিয়োগের পরিবেশ অনুকূল নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জ্বালানি সংকট, এবং দেড়-দুই বছর অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে পিছিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, গ্যাসের ঘাটতি এখন ব্যবসার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঋণের সুদের হার এত বেশি যে অনেক কারখানা শুধু সুদের চাপ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে।

ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন বেশি মন দিচ্ছে সরকারি সিকিউরিটিজে। ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ তাদের নতুন আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে। শক্তিশালী ব্যাংকগুলো বিশেষভাবে লাভবান হয়েছে সরকারি সিকিউরিটিজে উচ্চ আয়ের ফলে।

এর উদাহরণ ব্র্যাক ব্যাংক—যাদের বিনিয়োগ আয় ২০২০-২২ সালে যেখানে ছিল ৭০০-৮০০ কোটি টাকার মতো, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৮৮০ কোটি টাকায়—প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি।

সব মিলিয়ে, বেসরকারি খাতে ঋণের মন্থর গতি এখন শুধু আর্থিক সূচকের সমস্যা নয়; বরং বৃহত্তর অর্থনৈতিক আস্থার সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, সুশাসন ও ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠন ছাড়া ঋণপ্রবাহের গতি ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন।
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ

সর্বশেষ হালনাগাদ 4 days আগে

Leave A Reply

Exit mobile version