অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে যা ঘটেছে, তা ইতিহাসের অন্যতম বড় আর্থিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে সংঘটিত বেপরোয়া লুটপাটে ব্যাংক খাতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা দীর্ঘদিন কৌশলে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে ওই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা হয়, কিন্তু এতে লুটপাট রোধ হয়নি; বরং ছাপানো অর্থও চুরি হয়েছে। এর ফলে বেড়েছে তারল্য সংকট, তৈরি হয়েছে ভয়াবহ ডলার ঘাটতি এবং মূল্যস্ফীতির পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা পরে এক গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং এর চাপে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আগের সরকারের আমলে সংঘটিত আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে। বিভিন্ন সরকারি অনুসন্ধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, যার একটি বড় অংশ বৈধপথে বিদেশে পাচার হয়েছে।
লুটপাটের সেই টাকাগুলো একে একে খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে গত এক বছরে বেড়েছে ৩ লাখ কোটিরও বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবলোপনকৃত ঋণ, আইনি জটিলতায় আটকে থাকা এবং গোপন খেলাপি হিসাবগুলো যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম জানান, খেলাপি ঋণের সব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। শুধু অবলোপনকৃত ঋণই ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া অনেক গোপন খেলাপি ঋণও ব্যাংকের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
গত এক বছরে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার ঘাটতি এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে একাধিক ব্যাংক দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খায়। অনেক গ্রাহক তাদের আমানতের অর্থ তুলতে পারেননি। ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি হিসাবে কয়েকটি ব্যাংকের ঘাটতি ছিল—যা সুস্থ অর্থনীতিতে গুরুতর সংকেত।
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই চলতি হিসাব ঘাটতি বহুদিন চাপা রাখা হয়, যা ছিল ব্যাংক খাতের চূড়ান্ত ভঙ্গুরতার ইঙ্গিত। এই ভঙ্গুর খাত পুনরুদ্ধারে বর্তমান সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। গঠিত হয় তিনটি বিশেষ টাস্কফোর্স—একটি ব্যাংক খাত সংস্কারে, একটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং অন্যটি অর্থ পাচার রোধে। এসব টাস্কফোর্স প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা, পাচার হওয়া সম্পদ শনাক্ত ও জব্দ করার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি সন্দেহভাজন হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
২০২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। এর মধ্যে ৮৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, ৩৩ হাজার কোটি টাকা দৈনন্দিন কার্যক্রমের ঘাটতি মোকাবিলায় এবং ১১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আন্তঃব্যাংক গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় সরবরাহ করা হয়েছে।
এছাড়া সংকটাপন্ন ৫টি ব্যাংককে একীভূত করে সচল রাখতে আগামী এক বছরে ২ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এর লক্ষ্যে একটি 'ব্রিজ ব্যাংক' গঠনের কাজ চলছে। এই ব্রিজ ব্যাংক ধুঁকতে থাকা ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নিয়ে সেগুলোকে পুনর্গঠন করবে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির চরম পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মূলধন সংরক্ষণের হার নেমে এসেছে ৩.০৮ শতাংশে, যা ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এ হার হওয়া উচিত ১২ শতাংশের বেশি। প্রভিশন ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলো চরম সংকটে পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হিসাব করেছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারে কমপক্ষে ৪ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এ বিপুল অর্থায়ন ছাড়া খাতটির টেকসই চাঙ্গা হওয়া সম্ভব নয়। তবে ইতোমধ্যেই কিছু দুর্বল ব্যাংক স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলতি হিসাবের ঘাটতি সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং কিছুটা হলেও তারল্য সংকট কাটতে শুরু করেছে।
বিগত সরকারের সময় সংঘটিত দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ বিপর্যস্ত। বর্তমান সরকারের গৃহীত উদ্যোগ সময়োপযোগী ও যথার্থ। তবে এই উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। এখন প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একটি কার্যকর ও স্থিতিশীল ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৩ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে

