অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বোরোর ভরা মৌসুম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এবার ধান উৎপাদন হয়েছে। অথচ পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও অস্থির চালের বাজার। গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন খরচ ও ঈদে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় চালের দাম বাড়াতে হয়েছে বলে জানান মিল মালিকরা। আড়তদাররা বলছেন, মিল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেয়ায় তাদেরও বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২৭ জুন খুচরা বাজারে মোটা জাতের স্বর্ণ ও ইরি চাল ৪৮-৫২, মাঝারি আকারের পাইজাম বা লতা চাল ৫২-৫৮ ও মিনিকেট চাল কেজিপ্রতি ৬০-৭৮ টাকায় বিক্রি হয়। তবে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা, মোহাম্মদপুর কৃষি বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্বর্ণ ও ইরি চাল কেজিপ্রতি ৫৩-৫৫ টাকায়, পাইজাম বা লতা ৫৫-৬০ ও মিনিকেট ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ঈদের আগেও স্বর্ণ ও ইরি চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫৩ টাকায়, পাইজাম ৫২-৫৮ ও মিনিকেট চাল ৬৫-৬৮ টাকায়। অর্থাৎ মোটা চালের কেজিপ্রতি ৫-৬ টাকা দাম বেড়েছে। মিনিকেট ও নাজিরের মতো চিকন চালের ক্ষেত্রে এ দাম বেড়েছে ৬-৮ টাকা পর্যন্ত।
পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দিনাজপুরের পাশাপাশি নওগাঁ, কুষ্টিয়াসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় চাল পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়েছেন ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠান ও ট্রাক মালিকরা। কোরবানি ঈদকে ঘিরে নওগাঁ থেকে চট্টগ্রামে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকের ভাড়া প্রায় ১০ হাজার টাকা বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশে চালের দামে এর প্রভাব পড়েছে।
কারওয়ান বাজারের বাদশাহ রাইস এজেন্সির মালিক নূর হোসেন বলেন, ‘বাজারে এখন চালের খুব বেশি চাহিদা নেই। ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর এখনো বাজার জমজমাট হয়নি। বেচাবিক্রিও খুব বেশি নেই। আমরা এখনো ঈদের আগে আড়তে রাখা চালই বিক্রি করছি। নতুন চাল আনতে পারিনি। শুনেছি চালের দাম নিয়ে কারসাজি হচ্ছে, সেজন্য অপেক্ষা করছি। এখন যেকোনো সময় কমতেও পারে, বাড়তেও পারে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে তখন চাল তুলব।’
শস্যভাণ্ডার খ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁর বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ২-৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫১-৫২ টাকা, ব্রি-২৮ ৫৬-৫৭, সুভলতা ৫৭-৫৮, জিরাশাইল ৬২-৬৩ ও কাটারীভোগ ৬১-৬৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন মিল মালিক ও আড়তদাররা।
মালশন রাইস সেন্টারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী মানিক প্রামাণিক বলেন, ‘গত এক মাস বাজারে ক্রেতা নেই বললেই চলে। তাই আগের চালগুলোই এখনো শেষ করতে পারিনি। বাজার খুচরা পর্যায়ে এখনো স্থিতিশীল রয়েছে। এ মুহূর্তে পাইকারিতে চালের দাম বেড়ে যাওয়া অযৌক্তিক। খুচরা বাজারে কোনো সিন্ডিকেট হয় না। আড়ত ও মিলগেটে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে।’
বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক বলছেন নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদারও। তবে চালকলগুলো পুরোপুরি চালু হলে শিগগিরই চালের বাজার আবারো নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে মনে করছেন এ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ২-৩ টাকা বেড়েছে। কারণ এখনো জেলার বেশির ভাগ চালকল বোরো মৌসুমের ধান থেকে চাল উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করেনি। মোকামে চালের সরবরাহ সংকটের কারণে বর্তমানে বেশি দামে চাল কেনা-বেচা হচ্ছে।’
এদিকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন মোকামের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে বস্তাপ্রতি চালের দাম সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকার মতো বেড়েছে। জানতে চাইলে চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, ‘পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণে বস্তাপ্রতি চালে ১০-১২ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। সরবরাহ স্বাভাবিক হলে চালের দাম কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
সরকারিভাবে দেশে গত কয়েক মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদনের দাবি করা হলেও সাম্প্রতিক সময় দফায় দফায় চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত চাল আমদানি করেনি সরকার। ফলে সরকারি গুদামগুলোকে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ওপরই পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে।
চালের দাম নিয়ন্ত্রণ ও চাহিদা মেটানোর জন্য ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৪ লাখ ৫২ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৬ লাখ ৮৫ হাজার ও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ছয় লাখ টন চাল আমদানি করে সরকার। কিন্তু চলতি বছর দেশের মানুষের প্রধান এ খাদ্যপণ্যটি আমদানি করা হয়নি সরকার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর সুযোগ নিচ্ছেন মিল মালিকরা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ফলে সরকারের মজুদ কমার সুযোগে বিভিন্ন সময়ে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
জানতে চাইলে সাবেক খাদ্য সচিব মো. আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, ‘ঈদের আগে-পরে কয়েকদিন পরিবহন ব্যবস্থায় ট্রাকসহ কিছু যানবাহনের চলাচল সীমিত করা হয়েছিল। সেই অজুহাতে এখন চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়, একটি অজুহাত মাত্র। মূলত সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঈদের দুই-একদিন পর থেকে চালের এ দাম বাড়ানো হয়েছে। এবার আকাশ খারাপ নেই, বন্যা হয়নি, শিলাবৃষ্টিও সেভাবে হয়নি। এ ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ানো একেবারেই অযৌক্তিক বিষয়। ●
অকা/বাণিজ্য/ফর/সকাল/২৮ জুন, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 year আগে

