অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। প্রতিবেশি ভারত থেকে তুলনামূলকভাবে সস্তায় সুতা আমদানি করতে পারায় স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই দেশীয় সুতার পরিবর্তে ভারতীয় সুতার দিকেই ঝুঁকছে। এতে দেশের টেক্সটাইল মিলগুলো বিক্রিতে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে, গুদামজুড়ে জমেছে অবিক্রিত পণ্য, এবং অনেক মিল উৎপাদন আংশিকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানিয়েছে, ভারত থেকে সুতা আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে বিক্রি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এর ফলে মিলগুলো এখন ব্রেক ইভেন পয়েন্টেও পৌঁছাতে পারছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ইতোমধ্যে ৫০টিরও বেশি টেক্সটাইল মিল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের এই খাত বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “ভারত সরকার তাদের টেক্সটাইল রফতানিকারকদের নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে। সেই সুবিধা নিয়েই তারা বাংলাদেশে স্থানীয় বাজারের চেয়েও কম দামে, ডাম্পিং মূল্যে, সুতা বিক্রি করছে। বিষয়টি আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এনেছি।”
বিটিএমএর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ৩০ কাউন্টের সুতার দাম প্রতি কেজি ২.৪৫ থেকে ৩.০৫ ডলার পর্যন্ত, যেখানে ভারতীয় সুতার দাম চট্টগ্রাম বন্দরে সিঅ্যান্ডএফ (C&F) হিসেবে প্রায় ২.১৯ ডলার। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে প্রায় ০.৩০ ডলার সাশ্রয় পাওয়া যায় ভারতীয় সুতা আমদানিতে। দুই বছর আগেও এই পার্থক্য ছিল মাত্র ০.০৫ ডলার।
নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফতুল্লা ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, “দুই বছর আগেও আমি প্রায় সব সুতা স্থানীয় মিল থেকেই কিনতাম। এখন ৯০ শতাংশই আমদানি করছি। এতে প্রতি কেজিতে প্রায় ০.৩০ ডলার সাশ্রয় হয়, যা বড় অঙ্কে লাভ।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবেও দেখা গেছে, ২০২৪ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশের সুতা আমদানি আগের বছরের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেড়েছে। বিটিএমএর দাবি, চলতি বছরও সেই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
এনজেড স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউদজামান খান বলেন, “ভারতীয় সুতার দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় দেশীয় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। অনেক কারখানায় বিক্রি না হওয়া সুতা গুদামভর্তি হয়ে আছে। এখন অনেকেই ব্রেক ইভেন বা লোকসানে বিক্রি করছে।”
দেশের এক হাজার ৮৬৩টি টেক্সটাইল মিলের মধ্যে ৫২৭টি স্পিনিং মিল। এর প্রায় ৩০০টি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। রপ্তানি কমে যাওয়ায় এই মিলগুলোর মধ্যে ৭৩টি এখন স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু করেছে। তবে অনেকেই ভ্যাট না দিয়ে বিক্রি করছে, ফলে নিয়ম মেনে বিক্রি করা মিলগুলো আরও প্রতিযোগিতার চাপে পড়েছে।
শুধু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানই নয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এই খাতের টালমাটাল অবস্থায় উদ্বিগ্ন। একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, “আমরা টেক্সটাইল খাতে মেয়াদি ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছি। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনও অনেক কমানো হয়েছে। কারণ প্রায় সব মিল এখন টিকে থাকার সংগ্রামে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রতি কেজি সুতা তিন ডলারের নিচে বিক্রি করলে লোকসান হয়, অথচ অনেকেই বাধ্য হয়ে তার চেয়েও কম দামে বিক্রি করছে।”
উদ্যোক্তারা মনে করেন, মূল প্রতিযোগিতায় ভারতের অগ্রগতি এবং বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ নীতিগত সহায়তার বৈষম্য। গত তিন বছরে ভারত রপ্তানিকারকদের জন্য বিভিন্ন করছাড়, নগদ প্রণোদনা ও রাজ্য পর্যায়ের ভর্তুকি চালু করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রণোদনা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করেছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তহবিল ব্যয় বৃদ্ধিতে স্থানীয় উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে।
সালেউদজামান খান বলেন, “ভারতের টেক্সটাইল রপ্তানিকারকরা সরকারের প্রণোদনার কারণে প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত ০.২০ থেকে ০.২৫ ডলার পর্যন্ত বাড়তি লাভ করছে। এতে তারা বাংলাদেশে স্থানীয় দামের চেয়েও কম দামে বিক্রি করতে পারছে।”
তবে এই সংকট শুধু নীতিগত পার্থক্যের ফল নয়; বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও অবৈধ আমদানিকেও দায়ী করছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। লিটল স্টার স্পিনিং মিলসের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, “বন্ড মিসইউজ ও চোরাই পথে আসা বিপুল পরিমাণ সুতা ও ফেব্রিক বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কাস্টমসের শিথিলতার কারণে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।”
তার মতে, দেশে বছরে ১২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক বাজার থাকলেও স্থানীয় মিলগুলোর বিক্রি হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। বাকি সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ পণ্য অবৈধভাবে বাজারে প্রবেশ করছে, যা স্থানীয় উৎপাদনের জন্য বড় হুমকি।
অন্যদিকে, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, “বন্ড মিসইউজ কেউ কেউ করলেও এর পরিমাণ খুবই সীমিত। আসল সমস্যা নীতিগত বৈষম্যে—ভারত যেভাবে তাদের উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিচ্ছে, বাংলাদেশে তার উল্টোটা হচ্ছে।”
বর্তমানে দেশজুড়ে টেক্সটাইল কারখানাগুলোর গুদামগুলো অবিক্রিত সুতায় ভরে গেছে। শাহ ফতেহউল্লাহ টেক্সটাইল মিলসের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদ আলম জানান, “গুদাম ভর্তি হয়ে গেছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় এখন কারখানার ভেতরেই সুতা মজুত রাখতে হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে ২৫ হাজার স্পিন্ডল বন্ধ করেছি; শিগগিরই আরও ২৫ হাজার বন্ধের পরিকল্পনা রয়েছে।”
একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন লিটল স্টার স্পিনিং মিলসের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, “সাধারণত আমাদের মজুত ১০ শতাংশ থাকে, এখন তা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গুদামেও জায়গা নেই।”
অন্যদিকে, প্রসেসিং খাতেও মন্দা দেখা দিয়েছে। আবেদ টেক্সটাইল প্রসেসিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “সাধারণত এ সময়ে আমরা ৭০ শতাংশ সক্ষমতায় কাজ করি। কিন্তু এবার তা নেমে এসেছে ৫০ শতাংশের নিচে। বাজার এখন আমদানিকৃত সুতা ও কাপড়ে ভরে গেছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, টেক্সটাইল খাতের এই সংকট শুধু উৎপাদন পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব পড়ছে ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, পরিবহন ও রপ্তানি খাতেও। কারণ পোশাক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে টেক্সটাইল খাতই পুরো মূল্য শৃঙ্খলের মূল স্তম্ভ।
যদি নীতিগত সহায়তা, বন্ড সুবিধার সংস্কার ও প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ব্যয়ের দিকটি দ্রুত ঠিক না করা হয়, তবে বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে, এই সংকট আগামী বছরগুলোতে রপ্তানিতেও বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ●
অকা/তৈপোশি/ই/সকাল/১১ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 days আগে